২৮শে জুন, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ই আষাঢ়, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৭:৫৮ অপরাহ্ণ, জুন ২, ২০২০
জামালগঞ্জ প্রতিনিধি
কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার চিরায়িত ঐতিহ্য পাটি শিল্প। এই শিল্প বাংলাদেশের লোকালয়ে জীবন ঘনিষ্ট ও ঐতিহ্যবাহী লৌকিক উপাদান। এক সময়ে গ্রামের বাড়িতে অতিথি আসলে প্রথমে বসতে দেওয়া হতো পাটিতে। গৃহকর্তার বসার জন্য ছিল বিশেষ ধরনের পাটি। আগে সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার ৫টি গ্রামের প্রায় প্রতি ঘরেই শীতল পাটি বুনন ছিল পারিবারিক ঐতিহ্য। বিবাহযোগ্য কন্যার পাটিবোনা জ্ঞানকে ধরা হতো বিশেষ যোগ্যতা হিসেবে। গরমকালে শীতল পাটির কদর ছিল বেশি। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ্যের দুপুরে এই পাটি দেহ ও মনে শীতলতা আনত। বর্তমান যুগের আধুনিকায়নে পাটি শিল্পের স্থান দখল করে নিয়েছে সুরম্য টাইলস, ফ্লোরম্যাট ও প্লাস্টিকের পাটি।
উপজেলার সদর ইউনিয়নের সোনাপুর, চানপুর, দুর্গাপুর, কদমতলী ও ভীমখালী ইউনিয়নের কালীপুর গ্রামের সহস্রাধিক নারী, বধূ, কন্যাদের নান্দনিক শীতল পাটির কারুকাজ এখন হারিয়েছে জৌলুস। এসব গ্রামের ঐতিহ্যবাহী পাটি কারিগরেরা করোনা ভাইরাসে লকডাউনের কারণে তাদের দৈন্যদশায় জীবন পার করছে। বিভিন্ন হাট-বাজার ও পাহাড়ী অঞ্চল এবং নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর, কলমাকান্দা অঞ্চল থেকে পুরুষেরা মুর্তাসহ বেত সংগ্রহ করত। নারীরা প্রতিটি বাড়ির বারান্দা অথবা উঠুনে বুনন কাজে ব্যস্ত থাকত। দুই মাসের লকডাউনে মুর্তা আনতে না পারার কারণে পাটি বুনন কমে যাওয়ায় অভাব অনটনে ভোগছে এসব গ্রামের পাটি শিল্পীরা।
নারীরা পাটি বুনন করার পর পুরুষেরা ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পাটি বিক্রির কাজে ব্যস্ত থাকত। প্রতি এলাকা থেকে পাটি শিল্পীদের নিকট চাহিদা অনুযায়ী শীতল পাটির অর্ডার থাকত। তিন-চার জন নারী ৮-১০ দিনে একটি শীতল পাটি তৈরি করেন। বাজারে এর মূল্য ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা। সাধারণ পাটি ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা বিক্রি করে থাকেন। প্লাস্টিকের পাটি তৈরি হওয়ায় প্রায় পাকা বাড়িতে টাইলস, ফ্লোরমেটের দাম পাটির চেয়ে অনেক কম হওয়ায় পাটি শিল্পীরা বাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। এই পেশা থেকে সরে আসছেন অনেকে। আবার কেউ কেউ পূর্ব পুরুষদের শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখতে এই পেশায় কোন রকম টিকে আছেন।
অনেকে জানান, এই পেশা ছাড়া আর কোন পেশা জানা না থাকায় কোন রকমে এ পেশা চালিয়ে যাচ্ছি। সোনাপুর গ্রামের পাটি শিল্পী সবিতা রানী কর বলেন, আমাদের গ্রামে আগে প্রতি পরিবারের নারীরা পাটি বুননের কাজ করত। বর্তমানে প্রায় দেড় শতাধিক পরিবারের নারীরা এই পেশায় টিকে আছে। বর্তমানে মুর্তা গাছ (পাটি বুনন বেত) কমে যাওয়ায় পাটি শিল্প ধরে রাখা অনেক কষ্টকর হয়ে পড়েছে। শীতল পাটির মূল উপাদান কাঁচামাল মুর্তা বেত সংগ্রহ অনেক পরিশ্রম ও ব্যয়বহুল। পরিশ্রমের বিপরীতে বাজার দর ভালো না হওয়ায় দিন দিন আমরা এই শিল্পের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। এক সময় এলাকায় বড় ধরনের কোন কর্মকর্তা মন্ত্রী-এমপি আসলে আমাদেরকে আগেই শীতল পাটি বানানোর জন্য বলা হতো। আমরা যথাসম্ভব ভালো মানের নকশা করে শীতল পাটি তৈরি করে দিতাম। দশ বছর আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাহিরপুর এলে এলাকার ঐতিহ্য হিসেবে আমাদের এমপি রতন সাহেব আমাদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে তিনটি শীতল পাটি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দিয়েছিলেন। আমাদের তৈরি পাটি সুনামগঞ্জের উন্নয়ন মেলায় কুটির শিল্প হিসেবে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে সম্মাননা লাভ করে। সরকারি কোন সহায়তা না থাকায় আমরা দিনে দিনে এ শিল্পের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি।
সোনাপুর গ্রামের পাটি বিক্রেতা মাখন চন্দ্র বোষ (৮০) জানান, আমাদের গ্রামের নারীদের তৈরি পাটি আমরা বাজারে বাজারে বিক্রি করি। পূর্বে আমাদের এলাকায় পর্যাপ্ত মুর্তা পাওয়া যেত। দামও ছিল কম। কিন্তু এখন এই মুর্তা কমে যাওয়ায় অনেক দূর এলাকায় নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর, কলমাকান্দা এবং ময়মনসিংহ জেলার জারিয়া, নাজিরপুর থেকে মুর্তা আনতে হয়। এতে খরচ বেড়ে যায়। আগে প্রতি পাটিতে ৩শ’ থেকে সাড়ে ৩শ’ টাকা লাভ হত। এখন প্রতি পাটিতে ৫০-১০০ টাকা লাভ হয়। যা দিয়ে সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয়। সরকারিভাবে আমাদের ঋণ সহায়তা ও মুর্তা চাষের ব্যবস্থা করতে পারলে এ পাটি শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব।
সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনার ষোলো গ্রামের কায়েস্থ সমাজ উন্নয়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক কদমতলী গ্রামের বাসিন্দা বিমল চন্দ্র কর জানান, পাটি শিল্পীরা বেশির ভাগই ভূমিহীন। তাই তারা লাভ কম হলেও বাপ-দাদার ঐতিহ্য ধরে রাখতে এই পেশায় যুক্ত আছে। আমরা পুরকায়স্থ সম্প্রদায়ের হলেও পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে আমাদের নারীরা যুগের পর যুগ পাটি বুনত। এখন এই পেশায় লাভ কম হওয়ার কারণে অনেকে অন্য পেশায় চলে গেছে। বর্তমান সরকার বিসিক ব্যাংক অথবা অন্য কোন কারিগরী সংস্থার আওতায় এনে প্রশিক্ষণ এবং ঋণ দানের ব্যবস্থাসহ মুর্তা চাষের জন্য কয়েক একর খাস জায়গা বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করলে আমাদের এই পেশা আবার আগের মতো জাগ্রত হয়ে উঠবে।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মস্তাক আহমদ পলাশ
সহ-সম্পাদক : জুমা কবীর মীম
নির্বাহী সম্পাদক : নাজমুল কবীর পাভেল
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : উজ্জ্বল চৌধুরী।
মস্তাক আহমদ পলাশ কর্তৃক নিউ বর্ণমালা অফসেট প্রেস, রাজা ম্যানশন, জিন্দাবাজার, সিলেট থেকে মুদ্রিত ও অনামিকা এ/৩৪ পূর্ব শাহী ঈদগাহ, সিলেট থেকে প্রকাশিত।
ইমেইল : sylheterdinkalnews@gmail.com,
ফেইসবুক পেইজ : The Daily Sylheter Dinkal ০১৭২২১৮৮৫৫১, ০১৭৫৫৮৬৬২২২, ০১৭১২৫৪০৪২০, শ্রীহট্ট মিডিয়া লিমিটেডের একটি প্রতিষ্ঠান।
Design and developed by M-W-D