কাঁদছে হাছন রাজার জন্ম পিঞ্জিরা

প্রকাশিত: ৮:০৫ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ৩, ২০১৬

কাঁদছে হাছন রাজার জন্ম পিঞ্জিরা

hasain rajবিশ্বনাথের রামপাশা গ্রাম ঘুরে: ‘মাটিরও পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়ারে, কান্দে হাছন রাজার মন ময়নারে,’ পৃথিবী মায়ার মোহে ‘আটকে’ কেঁদে কেঁদে এমনই অনেক কালজয়ী গান সৃষ্টি করেছেন মরমি কবি হাছন রাজা।
কিন্তু যেখানে ১৮৫৪ সালে তার জন্ম, বিশ্বনাথের সেই রামপাশা  গ্রামে তার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ ছাড়া তেমন কোনো স্মৃতি নেই। চোখে পড়েনি তার একটি ছবি কিংবা গানের লিপিও।
অযত্নে অবহেলায় পড়ে থেকে যেনো সেই গানের মতোই বিলাপ করছে হাছনের জন্মভিটা। স্মৃতি চিহ্নের অভাবে যেনো কাঁদছে তার যৌবন-বৃদ্ধে কাঁটানো পিঞ্জিরা!
সরেজমিনে জন্ম ভিটা রামপাশা ঘুরে এমন চিত্রই চোখে পড়েছে। চোখে পড়েছে হাছনের থাকার ঘর, যেটি কদিন আগে পর্যন্ত রামপাশা পোস্ট অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তবে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এখন তা পরিত্যক্ত।
ঘরটিতে পশু-পাখির মূলমূত্রও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।  দুর্গন্ধে কারও সেখানে যাওয়ার জো নেই। এরপরও হাছনের স্মৃতির খোঁজে রামপাশায় ছুটে যান অনেকেই।

হাছন রাজার রামপাশার সম্পদের ওয়াকফ এস্টেটের ম্যানেজার আবদুল মতিন জানালেন, তৎকালীন জমিদার রাজা বাবু খাঁ হাছন রাজার দাদা। পরবর্তীতে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন তিনি। তাদের পূর্বপুরুষদের আধিবাস অয্যোধ্যায়।’
হাছন রাজার ভক্তরা ছাড়াও প্রায়ই দেশি-বিদেশি ফোকলোর গবেষকরা এখানে আসেন বলে জানালেন তিনি।

তার ভাষ্যে, ‘৫ লাখ ২০ হাজার বিঘা জমির মালিক ছিলেন  হাছন রাজারা। এখনও সিলেটের কোম্পানিগঞ্জ, বিশ্বনাথ, সুনামগঞ্জ, লক্ষণছিড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় এসব রয়েছে।’
অনেক জায়গায়, সুনামগঞ্জ শহরের নিকটবর্তী সুরমা নদীর তীরে লক্ষণছিরি (লক্ষণশ্রী) পরগণার তেঘরিয়া গ্রামে হাছনের জন্ম হয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে।
এ বিষয়ে বংশানুক্রমিকভাবে হাছন রাজার পরিবারের ঘনিষ্ট মতিন বলেন, ‘এটাই হাছন রাজার পৈত্রিক ভিটা। এখানে তার বাবা, দাদার জন্ম হয়েছে।’
‘সুনামগঞ্জ ছিলো তার হালগড়া (জমিদারি)। সেখানেও থাকতেন তিনি। যখন তিনি মারা যান (১৯২২) তখন ছিলো এয়ত (শুষ্ক)  মাস। তখন রামপাশায় নৌকা আসে না। গাড়ি-ঘোড়ার ব্যবস্থাও ছিলো না। নাওয়ের (নৌকা) সময় না থাকায় সেখানেই তাকে কবর দেওয়া হয় ।’

লন্ডনি’ অধ্যুষিত এলাকা বিশ্বনাথের উত্তরে সিলেট সদর ও ছাতক উপজেলা। পূর্-দক্ষিণের অংশ বালাগঞ্জ আর পশ্চিম অংশটি ঘিরে সীমানা একেঁছে ছাতক এবং জগন্নাথপুর উপজেলা।
কথিত আছে, বিশ্বনাথ রায় চৌধুরীর নাম থেকেই এসেছে ১৯২২ সালে প্রতিষ্ঠিত থানা বিশ্বনাথের। ২৮৭.৩৩ বর্গকিলোমিটারের এ উপজেলা শহর থেকে পশ্চিম-উত্তরে রামপাশা বাজার, এর ঠিক আগেই হাছন রাজার জন্মভিটার অবস্থান। আলাপের ফাঁকে ফাঁকে আবদুল মতিন ঘুরে দেখালেন, হাছন রাজার পুরো বাড়ি। বিশাল এলাকা নিয়ে তৎকালীন জমিদার বাড়িটি।

পুকুর, শান বাঁধানো ঘাট, ঘাটের শতবছরের পুরানো পাথর। অন্দরমহলের জন্যে বাড়ির উঠোনে তৈরি প্রাচীন দেয়াল। যা লতাগুল্মে ছেয়ে গেছে।
বললেন, তখন বাড়ির ভেতরে বাইরের কোনো পুরুষ আসতে পারতো না। তাই মাঝে ওয়াল (দেয়াল) তৈরি করা হয়। এই ওয়ালটা সাড়ে তিনশ’ বছর আগের তৈরি।
পরিত্যক্ত দ্বিতল ঘরটি দেখিয়ে আবদুল মতিন বলেন, শুনেছি এটি দেড়শ’ বছর আগের। হাছন রাজার ছেলেরাও একটা সময় এ ঘরে থেকেছেন। তবে এখন তার নাতির ছেলে-মেয়েরা আছেন। তারা দেখভাল করলেও কেউ থাকেন না রামপাশায়।

হাছনের কোনো স্মৃতি চিহ্নের বিষয়ে জানার আগ্রহ দেখালেই তিনি নিয়ে গেলেন খাপনা নদীর জলমহাল থেকে রামপাশা বাজারের দিকে যাওয়া সড়কের মোড়ে।
যেখানে একটি ফলকে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে, ‘দ্য বার্থ প্লেস অব দ্য রিনাউনড পোয়েট দেওয়ান হাছন রাজা, কম্পোজার অব ফোকলোরস (রামপাশা)। চিহ্ন বলতে আছে শুধু এটাই। ঘরে নিয়ে মরমি কবি হাছন রাজার একটি ছবিও দেখালেন।
বাড়ির পূর্ব পাশে মাদ্রাসা-মসজিদের সামনে কবরস্থানে রয়েছে বাবু রায় চৌধুরী ওরফে বাবু খাঁর সমাধি, আছে হাছনের তৃতীয় স্ত্রীর কবরও।
এদিকে হাছন রাজার বাড়ির সামনের বিশাল দিঘিসহ খোলা জায়গায় স্মৃতি জাদুঘর কিংবা সাংস্কৃতিক ইনস্টিটউট গড়ে তোলার পক্ষে দাবি জানিয়েছেন অনেকে। তাদেরই একজন স্থানীয় বাসিন্দা মো. ফেরদৌস আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘এ ধরনের কিছু হলে হাছন রাজা বিষয়ে অনেক অজানা বিষয়ই জানা যাবে। ’
এ বিষয়ে আবদুল মতিন বলেন, হাছন রাজার ঘরবাড়ি ছাড়া এখানে তার কোনো স্মৃতি নেই। সব সিলেটে ‘মিউজিয়াম অব রাজাস’ এ রাখা হয়েছে।

তবে হাছন রাজা পরিবারের সদস্য দেওয়ান তাছাওয়ার রাজা চৌধুরী রামপাশায় একটি কমপ্লেক্স তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে তাছাওয়ার রাজা হাসপাতালে থাকায় এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দিহান তিনি।

বাংলাদেশের যেকোনো জায়গা থেকে সিলেটে এসে সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ অন্যান্য বাহনেও যাওয়া যায় রামপাশা গ্রামে, সিলেট জেলা শহর থেকে এর দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

ফেসবুকে সিলেটের দিনকাল