২৯শে নভেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৭:৩০ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ৩, ২০১৬
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী কার্যক্রম বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে আলোচনায় এসেছে দুই জঙ্গি শীর্ষ নেতা তামিম আহমদ চৌধুরী ও জিয়াউল হকের নাম। তামিম কানাডা প্রবাসী হলেও আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর বাংলাদেশে খিলাফত দলের প্রধান, সে একাধিকবার বাংলাদেশ সফর করে গেছে, এবং গোয়েন্দাদের ধারণা গুলশান হামলাকে কেন্দ্র করে সে দেশেই আছে। এদিকে, জিয়াউল হক সেনাবাহিনী থেকে চাকরীচ্যুত একজন মেজর, এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের স্লিপার সেলের জন্ম এবং প্রশিক্ষণদাতা।
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিস্তারের নেপথ্যের এ দুজনের বাড়ি সিলেট বিভাগে। তন্মধ্যে তামিম আহমদ চৌধুরীর বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার থানায়, এবং মেজর জিয়াউল হকের বাড়ি সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলাধীন মোস্তফাপুরে।
কে এই তামিম আহমদ চৌধুরী
সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার দুবাগ ইউনিয়নের বড়গ্রাম সাদিমাপুরের প্রয়াত আবদুল মজিদ চৌধুরীর নাতি তামিম। আবদুল মজিদ চৌধুরী একাত্তরে শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
তামিমের বাবা শফিক আহমেদ চৌধুরী জাহাজে চাকরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি পরিবার নিয়ে কানাডায় চলে যান। পরিবারের সঙ্গে কানাডার উইন্ডসরে থাকত এ জঙ্গিনেতা তামিম। ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর সে ইত্তেহাদ এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে আসে। এরপর থেকে নিখোঁজ।
মূলত দেশে ফেরার পর থেকেই তামিম জেএমবিকে নতুন করে সংগঠিত করতে শুরু করে। জেএমবির নতুন এই ধারাটি হয়ে ওঠে অনেক বেশি শক্তিশালী ও ধ্বংসাত্মক। কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের সময় আহত অবস্থায় গ্রেফতার রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, জাহাজ বিল্ডিং নামে পরিচিত তাজ মঞ্জিলের আস্তানায় অন্য ‘বড় ভাই’দের পাশাপাশি নিয়মিত যাওয়ার পাশাপাশি অভিযানে নিহত জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ ও আর্থিকভাবে সহায়তার কাজ করত এ তামিম আহমদ চৌধুরী।
এদিকে পুলিশ তামিমকে জেএমবি নেতা বললেও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের বিভিন্ন প্রকাশনায় দাবি করা হয়, সে সংগঠনটির বাংলাদেশ শাখার সমন্বয়ক। এর ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোও তাকে আইএস সমন্বয়ক হিসেবে উল্লেখ করেছে।
কানাডার পত্রিকা ন্যাশনাল পোস্টের এক খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরী আইএসের কথিত ‘বাংলার খিলাফত দলের প্রধান’। তবে তার সাংগঠনিক নাম শায়খ আবু ইব্রাহিম আল-হানিফ। সে কানাডা থেকে বাংলাদেশে পৌঁছেছে। গত ১৩ এপ্রিল আইএসের কথিত মুখপত্র ‘দাবিক’-এর ১৪তম সংখ্যায় আবু ইব্রাহিম আল-হানিফের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হয়। এতে জানানো হয়, কৌশলগত কারণে বাংলাদেশে শক্ত ঘাঁটি করতে চায় আইএস।
কে এই মেজর জিয়াউল হক
জিয়ার পুরো নাম সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক। তার বাবার নাম সৈয়দ মোহাম্মদ জিল্লুল হক। তার গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারের মোস্তফাপুরে। সর্বশেষ সে মিরপুর সেনানিবাসে থাকত।
২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি সেনা সদর দপ্তরের পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২০১১ সালের ডিসেম্বরে সেনাবাহিনীর সাবেক ও তৎকালীন কিছু সদস্য দেশের গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত এবং সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে। অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে মেজর জিয়া অন্যতম বলে জানা যায়। মেজর জিয়া জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল বলেও সেনা সদর দপ্তর জানিয়েছিল। এই অভ্যুথানচেষ্টার পেছনে ইশরাক আহমেদ নামে তার এক প্রবাসী বন্ধু যুক্ত ছিল।
গোয়েন্দারা বলছেন, অভ্যুথানচেষ্টার সঙ্গে যুক্তরা হিযবুত তাহরিরকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছিল। পরে মেজর জিয়া এবিটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে একের পর এক টার্গেট কিলিং মিশন বাস্তবায়ন করে। গত বছরের ৯ জানুয়ারি পাকিস্তানের করাচিতে সে দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে এজাজ ওরফে সাজ্জাদসহ আল কায়দার চার জঙ্গি নিহত হয়। ওই সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হয়, এজাজ আল কায়দার কমান্ডার এবং এবিটির অন্যতম শীর্ষ নেতা ছিল। তার মৃত্যুর পর এবিটির নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে। জসীমুদ্দিন রাহমানী জেলে থাকায় সে সময় তার স্থলে তাত্ত্বিক নেতা হয় পুরান ঢাকার ফরিদাবাদের এক মাদ্রাসা শিক্ষক। আর সামরিক শাখার একক নেতৃত্বে আসে মেজর জিয়া। গ্রেফতার হওয়ার পর জসীমুদ্দিন রাহমানী জিজ্ঞাসাবাদে বলেছ, সে ঢাকা ও চট্টগ্রামে একাধিকবার জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছে। সংগঠনে জিয়ার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের পর এবিটি ‘আনসার আল ইসলাম’ নাম ধারণ করে।
এবিটির স্লিপার সেল তৈরিতে জিয়া
দেশে ব্লগার, প্রকাশক, মুক্তমনা লেখকসহ অন্তত নয়জনকে টার্গেট করে হত্যার নেপথ্যে মেজর জিয়া ছিল বলে গোয়েন্দাদের ধারণা। গোয়েন্দাদের ধারণা, আশপাশের দেশের কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গেও তার যোগাযোগ রয়েছে। দেশকে অস্থিতিশীল করার পাশাপাশি সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে গুপ্তহত্যাসহ নানা পরিকল্পনার নেপথ্যে এ জিয়া। গত তিন বছরে তার তত্ত্বাবধানে এবিটির অন্তত আটটি স্লিপার সেল তৈরি হয়েছে। প্রতিটি সেলের সদস্য সংখ্যা চার থেকে পাঁচজন। সেই হিসাবে অন্তত ৩০ জন দুর্ধর্ষ ‘স্লিপার কিলার’ জঙ্গি তৈরি করেছে মেজর জিয়া। তারাই ব্লগার, প্রকাশক, মুক্তমনা ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের হত্যা করেছে বলে ধারণা গোয়েন্দাদের।
২০১১ সালের ডিসেম্বরে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান চেষ্টার পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে অন্যতম এই মেজর জিয়া। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, গত পাঁচ বছর পলাতক থেকে জিয়া দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিস্তারে অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করছে।
রাজধানী ও এর আশপাশে টার্গেট কিলিংয়ে জড়িত কয়েকজন জঙ্গিকে গ্রেফতারের পর মেজর জিয়ার নাম জানা যায়। তা ছাড়া এসব জঙ্গির মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড পর্যালোচনা, ই-মেইল অ্যাকাউন্ট, ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্ট ঘেঁটেও অনেক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) একাংশের সঙ্গেও মেজর জিয়ার যোগাযোগ রয়েছে।
এদিকে, মঙ্গলবার পুলিশ সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেন, টার্গেট কিলিংয়ের সঙ্গে জড়িত একটি গ্রুপ হচ্ছে এবিটি। তদন্ত থেকে ধারণা পাওয়া গেছে যে, এই গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া।
৯ হত্যার নেপথ্যে জিয়া
২০১৩-২০১৫ সালের মধ্যে পাঁচজন ব্লগার, একজন প্রকাশক ও সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করতেন এমন দু’জনকে হত্যা করেছে এবিটি। এই সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হত্যার পেছনেও এবিটি জড়িত। এসব ঘটনার তদন্ত করে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে জিয়ার নাম উঠে এসেছে।
এ বছরের ২৫ এপ্রিল কলাবাগানের একটি বাসায় জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব তনয় নামে দু’জনকে হত্যা করে এবিটির স্লিপার সেলের সদস্যরা। তারা দু’জনই সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করতেন। এর আগে চলতি বছরের ৫ এপ্রিল রাজধানীর সূত্রাপুরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিমুদ্দিন সামাদকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির অদূরে বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার ড. অভিজিৎ রায়, তেজগাঁওয়ে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু, সিলেটের সুবিদবাজার এলাকায় ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ, রাজধানীর গোড়ানে ব্লগার নীলাদ্রি চ্যাটার্জি ওরফে নিলয়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই বছরের শেষ দিকে আজিজ সুপার মার্কেটে নিজ কার্যালয়ে হত্যা করা হয় জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপনকে। এর আগে ২০১৩ সালে রাজধানীর পল্লবীতে খুন হন ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার। এ হত্যাকাণ্ডগুলোতেও জিয়াউল হকের ইন্ধন রয়েছে।
ধরিয়ে দিলে পুরষ্কার
ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার মূল হোতা বা মাস্টারমাইন্ড আইএসের কথিত বাংলাদেশ সমন্বয়ক তামিম আহমদ চৌধুরী ও সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়া সাবেক সেনা সদস্য মেজর জিয়াকে ধরিয়ে দিলে পুরষ্কারের ঘোষণা দিয়েছে পুলিশ।
এই দুজন আরও বড় নাশকতার ছক করেছিল বলে জানিয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহিদুল হক মঙ্গলবার (২ আগস্ট) ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “এই দুজনকে গ্রেপ্তার করতে কেউ সহযোগিতা করলে ২০ লাখ টাকা করে পুরষ্কার দেয়া হবে।”
সম্পাদক ও প্রকাশক : মস্তাক আহমদ পলাশ
সহ-সম্পাদক : জুমা কবীর মীম
নির্বাহী সম্পাদক : নাজমুল কবীর পাভেল
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : উজ্জ্বল চৌধুরী।
মস্তাক আহমদ পলাশ কর্তৃক নিউ বর্ণমালা অফসেট প্রেস, রাজা ম্যানশন, জিন্দাবাজার, সিলেট থেকে মুদ্রিত ও অনামিকা এ/৩৪ পূর্ব শাহী ঈদগাহ, সিলেট থেকে প্রকাশিত।
ইমেইল : sylheterdinkalnews@gmail.com,
ফেইসবুক পেইজ : The Daily Sylheter Dinkal ০১৭২২১৮৮৫৫১, ০১৭৫৫৮৬৬২২২, ০১৭১২৫৪০৪২০, শ্রীহট্ট মিডিয়া লিমিটেডের একটি প্রতিষ্ঠান।
Design and developed by M-W-D