জঙ্গি হামলা ও পুলিশি অভিযান নিয়ে বিশিষ্টজনদের অভিমত: আস্থাহীনতায় আতঙ্ক কাটছে না

প্রকাশিত: ২:০৮ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৯, ২০১৬

জঙ্গি হামলা ও পুলিশি অভিযান নিয়ে বিশিষ্টজনদের অভিমত: আস্থাহীনতায় আতঙ্ক কাটছে না

1469724858দেশজুড়ে একের পর এক জঙ্গি হামলা বিশেষ করে রাজধানীর গুলশান ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ভয়ঙ্কর জঙ্গি হামলার পুলিশি অভিযানে এখনো জনমনে স্বস্তি ফিরে আসেনি। আরো ভয়াবহ জঙ্গি হামলার আশঙ্কায় সারাদেশে এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে। রাজধানীর কল্যাণপুরে পুলিশের সফল অভিযানে ৯ জঙ্গি নিহত হওয়ার পর পুলিশের বক্তব্য নিয়ে নানা প্রশ্নের প্রেক্ষিতে বিশিষ্টজনেরা বলেন, কল্যাণপুরের অভিযান নিয়ে পুলিশের কথায় আস্থা পাচ্ছে না জনগণ। পুলিশ কথিত ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যাকান্ডের পর দীর্ঘদিন ধরে পুলিশের সাজানো বক্তব্য দেয়ার মানুষ তা বিশ্বাস না করায় আস্থাহীনতা তৈরি হয়। কয়েকজন জঙ্গিকে হত্যা করে তা নির্মূল করা যাচ্ছে না তা এবারের জঙ্গি হামলায়ই প্রমাণ করেছে। জঙ্গি হামলা শুধু আইনশৃঙ্খলাজনিত অপরাধ নয়। জঙ্গি হামলা ঠেকাতে সর্বমহল একমত হলেও বিভক্তি দূর করে একটি কাঠামোতে গণতান্ত্রিক পরিবেশে আসতে না পারলে এর ফল পাওয়া যাবে না। পুলিশ সহজেও মানুষের আস্থা পাবে না। আর পুলিশের  প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতাই জঙ্গি হামলার আতঙ্ক কমছে না। রাজধানীর গুলশানে ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর সারাদেশেই জঙ্গি হামলার ভয়াল আতঙ্কে পড়ে দেশের মানুষ। পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও আনসার নিয়ে যৌথবাহিনী সারাদেশেই অভিযানে নামে। গত মঙ্গলবার ভোররাতে রাজধানীর কল্যাণপুরে একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ৯ জঙ্গিকে নিহত ও আটক করে ১ জনকে। সারাদেশে পুলিশ সর্বোচ্চ নিরাপত্তাবলয় গড়ে তুললেও আতঙ্ক কাটছে না। স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরে আসছে না। বরং কল্যাণপুরের পুলিশি অভিযান নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রশ্ন। বিবিসির প্রতিবেদনেই দেখা যায় বাংলাদেশের ঢাকার কল্যাণপুরে পুলিশের অভিযানের বিষয়ে এখন প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। বিরোধীদলের পক্ষ থেকেও শুধু নয়, সামাজিক গণমাধ্যমেও এই অভিযান ও নিহতদের বিষয়েও সন্দেহ তোলা হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তাও জবাব দিলেন ফেসবুকে। এসব প্রশ্ন ও সন্দেহ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা। … প্রশ্ন হচ্ছে, যাদের নাম, ঠিকানা, পরিচয় এখনো পুলিশ জানে না, তাদের জঙ্গি পরিচয়, শিক্ষাগত যোগ্যতা, গুলশান হামলার সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়ে কীভাবে নিশ্চিত হলো পুলিশ? নিহতরা আসলে কারা? এই চার পিস্তল দিয়ে হাজার খানেক পুলিশের সঙ্গে কতক্ষণ লড়াই সম্ভব?…গভীর রাতে পুলিশি অভিযানের সময়ে জঙ্গিরা এ রকম পাঞ্জাবি, কেডস পরে ঘুমাতে গিয়েছিল কেন? ৪টি পিস্তল দিয়ে কীভাবে সারারাত মুহুর্মুহু গুলি চালানো সম্ভব? কেন তাদের জীবিত ধরা গেল না। গুলশানের হত্যাকান্ডের পর হামলাকারীদের আইএস-এর পতাকা ও কালো পোশাক পরা ছবি প্রকাশ করা  হয়েছিল। আগে ৫ জঙ্গি ভিন্ন স্থান থেকে অভিযানে এলেও এখানে একসাথে ১১ জঙ্গি আসল কীভাবে। আশপাশের মানুষ এনিয়ে নানা প্রশ্ন তোলায় পুলিশের ইতিহাসের এ সফল অভিযানটি নিয়ে জনমন ও সামাজিক মাধ্যমে হচ্ছে নানা আলোচনা। মূলত দেশের মানুষের জঙ্গি হামলার আতঙ্ক কাটছে না। : নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, পুলিশের প্রতি অতীতের আস্থাহীনতায় এখন মানুষ পুলিশের বক্তব্য বিশ্বাস করতে পারছে না। আর কয়েকটা জঙ্গিকে হত্যা করেই জঙ্গি হামলা ঠেকানো যাবে না। দেশের তরুণ সমাজের একটা অংশ এমনকি বিদেশে লেখাপড়া করে জঙ্গিতে যোগ দেয়ায় এদের পরিধি বেড়েছে। এটা একদিনে হয়নি। দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক হানাহানি থেকে শুরু করেই নানা হতাশা থেকেই তরুণরা এ বিপজ্জনক পথে হেঁটেছে। এ বিষয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক ঐকমত্য তৈরি হলেও রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে এক কাঠামোতে আসতে পারছে না। দেশের সর্বত্রই আতঙ্ক থাকাটাই স্বাভাবিক। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সাবধানে অভিযান চালানো উচিত। কল্যাণপুরে তাদের অভিযান নিয়ে আমারও অনেক প্রশ্ন থাকতে পারে। কারণ পুলিশ আগে একপ্রকার কাজ করে অন্য কাজ প্রচার করায় মানুষ তাদের বিশ্বাস করে না। আমাদের সকলকে স্ব স্ব অবস্থান থেকে এ ব্যাপারে কাজ করা উচিত। : নাগরিক অধিকার সুরক্ষা কমিটির আহবায়ক ও সুপ্রিম কোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, জঙ্গি হামলার প্রেক্ষিতে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আতঙ্ক থাকাই স্বাভাবিক। আবার এই পরিস্থিতিতে গুজব চলা স্বাভাবিক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেক ভুলভ্রান্তি করলেও এদের সার্বিকভাবে জনগণের আস্থা অর্জন করা উচিত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি জনগণের আস্থাহীনতার কারণেই আতঙ্ক কাটছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধের গল্প সাজিয়ে হত্যাকান্ড করায় এখন কল্যাণপুরের অভিযান মানুষ বিশ্বাস করতে পারছে না। জঙ্গি হামলার পর অভিযানে নামে গ্রেফতার বাণিজ্য এরাই করেছে। তাই বহু বছর ধরে মানুষ পুলিশের কথা বিশ্বাস করে না। পুলিশের প্রতি আস্থাহীনতাই মানুষ আরো বেশি আতঙ্কিত হচ্ছে। আর আতঙ্কিত হওয়াই স্বাভাবিক। পুলিশ সহজে এ আস্থা ফিরিয়েও আনতে পারবে না। : এ পরিস্থিতিতে সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার কারণ রয়েছে বলে মনে করেন মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান। তিনি বলেন, গুলশান হামলার পর পুলিশের দৃশ্যমান নিরাপত্তা তৎপরতা সাধারণ মানুষকে নিশ্চিন্ত করতে পারেনি। তিনি বলেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সতর্কবার্তা দেয়ার কিছু কৌশল আছে, আমার মনে হয়, পুলিশ সেখানে ভুল করছে ফলে উল্টো আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। আর এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, কয়েকটা জঙ্গিকে হত্যা করলেই জঙ্গি হামলার আতঙ্ক দূর হয়ে যাবে। অতীতে ফাঁসি দিয়ে দন্ড দিয়ে হত্যা করে জঙ্গি হামলা থেমে গেলেও শেষ হয়নি। পুলিশের দীর্ঘদিন এটা মনে করার কারণেই এবার আরো ভয়াবহ হামলা হয়েছে। তবে পুলিশের অভিযান ও আতঙ্ক নিয়ে মানুষ কোনোভাবেই আস্থা পাচ্ছে না। কারণ কল্যাণপুরের পুলিশের অভিযানে আমার মনেও অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। পুলিশের একেকজন একেক স্থান থেকে এনিয়ে বক্তব্য দেয়ায় আরো বিভ্রান্তি হয়েছে। কল্যাণপুরের নিহতরা পরিবার থেকে স্বেচ্ছায় দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন থাকায় তারা জঙ্গি সংগঠনে জড়িত স্পষ্টতই বুঝা যায়। তবে পুলিশের কৌশলগত অভিযান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে এ ধরনের অভিযান বা এদের কয়েকজনকে হত্যা করে জঙ্গি হামলা ঠেকানো যাবে না। তিনি বলেন, দেশের সকল শ্রেণি, পেশা ও দলের মানুষ এই পয়েন্টে একমত হলেও এক কাঠামোতে আসতে না পারায় জঙ্গি দমন করা যাচ্ছে না। সমস্যাটা থেকেই যাবে। দেশের জন্য ভবিষ্যৎ আরো ভয়ানক সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক পরিবেশে সব বিভক্তি দূর করে সকলের একমতকে এক কাঠামোয় আনতে না পারলে এ সমস্যা দূর হবে না।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

ফেসবুকে সিলেটের দিনকাল