সিলেট ২৮শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই ফাল্গুন, ১৪২৭ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১:০২ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৯, ২০১৬
উজ্জ্বল মেহেদী: পেশায় দলিল লেখক। নেশায় পত্রিকা পাঠক। কাগজ পড়ার শুরু সেই ১৯৬৫-তে। শৈশবে যে নেশার শুরু, পাঁচ দশক পর এখনো নিয়মিত তার চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর। আর পড়ে ফেলা পত্রিকাগুলো বেচে না দিয়ে সংরক্ষণ করেছেন অতি যত্নে। দেখতে দেখতে পুরোনো পত্রপত্রিকার বিশাল এক সংগ্রহশালা গড়ে উঠেছে তাঁর বাড়িতে।
সঠিক হিসাব না থাকলেও বাড়ির পাঁচটি কক্ষে থরে থরে সাজানো রয়েছে কয়েক হাজার দৈনিক, সাপ্তাহিক ও ম্যাগাজিন। সিলেটের প্রাচীনতম পত্রিকা থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের নানা পত্রিকা রয়েছে তাঁর সংগ্রহশালায়। পত্রিকাপ্রেমী এই মানুষটির নাম মো. মুদাব্বির হোসেন। বাড়ি সিলেটের দক্ষিণ সুরমার সিলাম গ্রামে।
সিলেটের বহু পুরোনো পত্রিকা যুগভেরী থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের নানা পত্রিকা ও ম্যাগাজিন রয়েছে এই সংগ্রহশালায়। সিলেট থেকে ১৯৩০ সালে প্রকাশিত বাংলা সংবাদপত্র যুগভেরীর সাপ্তাহিক ও দৈনিক, বিলুপ্ত আজকের সিলেট, দৈনিক বৃহত্তর সিলেটের মানচিত্র, সিলেট প্রতিদিন, সিলেট সমাচার, জালালাবাদী, সিলেট কণ্ঠ, সিলেট ধ্বনি, অনুপমসহ বিভিন্ন পত্রিকা রয়েছে মুদাব্বিরের সংগ্রহে। এ ছাড়া আছে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পাকিস্তান, উর্দু পত্রিকা জং, হক কথা (ভাসানী সম্পাদিত), আজাদ, গণকণ্ঠ, নব অভিযান, জনপদ, মুক্তিযুদ্ধকালীন পত্রিকা জয়বাংলা, অগ্রদূত, চরমপত্র, দৈনিক বাংলা, জাহানে নও, ইত্তেসান, বাংলার বাণী, দৈনিক রূপালী ও খবর। রয়েছে বর্তমান সময়ের আজকের কাগজ, ইত্তেফাক, ইনকিলাব, খবর, সংবাদসহ আরও অনেক দৈনিক। আর সাপ্তাহিকের মধ্যে রয়েছে হলিডে, রূপসী বাংলা, রূপকথা। ম্যাগাজিনও সংগ্রহে কম নেই। এই তালিকায় রয়েছে বেগম, বিচিত্রা, চিত্রালী, পূর্বাণী, পূর্ণিমা, খবরের কাগজ, চলতিপত্র, যায়যায়দিন, আগামী ও প্রিয়জন।
নিতান্ত শখ থেকে পত্রিকা সংগ্রহের এই কাজ এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। নিজের সংগ্রহশালার দিকে ইঙ্গিত করে আবেগতাড়িত কণ্ঠে মুদাব্বির বললেন, ‘এ হচ্ছে আমার জীবনের পাঠ।’
বসতঘর ও বাংলোর পাঁচটি কক্ষজুড়ে এই সংগ্রহশালা। ইতিমধ্যে চারটি কক্ষ পত্রিকায় ভরে গেছে। বাকি কক্ষের এক পাশে রয়েছে বেঞ্চ আদলের একটি খাট। সেখানেই বসে পত্রিকা পড়েন মুদাব্বির। মাস শেষে পত্রিকাগুলো সংগ্রহ করে রাখেন ওই কক্ষেই। জানালেন, এই কক্ষটিও পূর্ণ হয়ে গেলে নতুন আরেকটি কক্ষ নেবেন পত্রিকার জন্য।
সংগ্রহশালার প্রতিটি বান্ডিলে জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা আলাদা করে রাখা। একেকটি বান্ডিলে এক সপ্তাহের পত্রিকা, যা সংখ্যায় ৪০ থেকে ৭০টি। মাঝেমধ্যে বান্ডিল খুলে বাড়ির উঠানে রোদে শুকাতে দেন মুদাব্বির।
তাঁর নানা দক্ষিণ সুরমার ভার্থখলার বাসিন্দা তৈয়বুর রহমান আজাদ নিয়মিত পত্রিকা পড়তেন। নানার অভ্যাসটাই একসময় রপ্ত করে ফেলেন মুদাব্বির। তখন তিনি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। নানার পড়া পত্রিকাগুলো যত্ন করে বাড়িতে এনে পড়তেন ও সংগ্রহ করতেন। ১৯৬৭ সালে সিলেটের আদালতপাড়ায় দলিল লেখক হিসেবে পেশাগত জীবনের শুরু। মূলত তখন থেকেই পত্রিকা কিনেও পড়া শুরু তাঁর।
প্রযুক্তির কল্যাণে পত্রিকাশিল্পে নানা পরিবর্তন এসেছে। যুগে যুগে সেই পরিবর্তনের বড় সাক্ষী হয়ে আছে মুদাব্বিরের এই সংগ্রহশালা। পৃষ্ঠাসজ্জা ও ছাপায় পরিবর্তন সময়েরই দাবি বলে তাঁর অভিমত। লেটার প্রেস থেকে অফসেট প্রেস, সাদাকালো থেকে রঙিন, ভাষারীতির পরিবর্তন—সবকিছু সময়ের বিবর্তনে ঘটেছে বলে মনে করেন তিনি।
অভিজ্ঞ এই দলিল লেখক বলেন, একটি পত্রিকাকে পাঠকপ্রিয় করে রাখার পূর্বশর্ত হচ্ছে খবর পরিবেশনে বস্তুনিষ্ঠতা। তিনি নিজেও খবরের বস্তুনিষ্ঠতার সন্ধানে একাধিক পত্রিকা পড়েন। নিজের সংগ্রহকে একরকমের ইতিহাস আখ্যা দিয়ে মুদাব্বির বলেন, ‘এটা প্রথমত আমার ঘরের জন্য, আমার সন্তানদের জন্য রাখছি।’
সংসারে স্ত্রী ছাড়াও কলেজপড়ুয়া এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। মুদাব্বিরের দেখাদেখি তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েও নিয়মিত পত্রিকা পড়েন। স্ত্রী শেফালি হোসেন বলেন, ‘বিয়ের আগে কখনো পত্রিকা পড়িনি। বিয়ের পর এ বাড়িতে এসে পত্রিকা পড়া আর ঘরজুড়ে সংগ্রহ দেখে প্রথম প্রথম খারাপ লাগত। একপর্যায়ে আমিও অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। এখন পত্রিকাগুলোর দেখভালও করি।’
একমাত্র ছেলে তানভির হোসেন সিলেটের মদনমোহন কলেজের স্নাতক শিক্ষার্থী। তাঁর ভাষায়, বাবার এই সংগ্রহশালা ইতিহাস। এটা ভবিষ্যতে সংরক্ষণ করে রাখার চিন্তা আছে।
পেশাগত কারণে মুদাব্বিরের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলামের। তিনি বলেন, প্রতিদিন একাধিক পত্রিকা বগলদাবা করে বাড়ি নিয়ে যান মুদাব্বির। তাঁর এই পাঠাভ্যাস নিঃসন্দেহে বিরল।
মুদাব্বিরকে এক নামে চেনেন স্থানীয় অনেক সংবাদপত্র পরিবেশক। অন্যতম পুরোনো পরিবেশক ‘আলমগীর এন্টারপ্রাইজ’-এর মালিক ইসমাইল হোসেন বলেন, পাকিস্তান আমলে পত্রিকা ছিল কম। যেগুলো আসত সবই কিনতেন মুদাব্বির।
নিজ প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক খাতা দেখে ইসমাইল হোসেন জানান, ১৯৭৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতিদিন পত্রিকা কিনেছেন মুদাব্বির। দিনে সর্বোচ্চ ২০টিও নিয়েছেন। ১৯৯১ সালের পর পত্রিকার সংখ্যা বাড়লে তাঁর মাসে বিল আসত কয়েক হাজার টাকা। মাঝেমধ্যে বিল বকেয়া পড়লে টাকার জন্য তাগাদা দিলে তিনি বলতেন, ‘পড়া জমাইয়া রাখলাম!…মাইর যাইত নায়, জমিজামা বিক্রি করি হইলেও বিল দিমু!’
বাস্তবে দুবার জমি বিক্রি করে বিল পরিশোধও করেছেন।
মুদাব্বিরের এই পত্রিকাপাঠ ও সংগ্রহকে ‘অমূল্য’ হিসেবে অভিহিত করেছেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের উপ-গ্রন্থাগারিক মো. সোহরাব হোসেন। তিনি বলেন, পত্রপত্রিকার সংগ্রহ দেশ-বিদেশের ঘটনাপ্রবাহের একটি দালিলিক প্রমাণ। নিঃসন্দেহে এটি অমূল্য। কিন্তু যথাযথ প্রক্রিয়ায় এগুলো সংগ্রহ করে না রাখতে পারলে এর কোনো মূল্য নেই। তিনি পত্রিকাগুলো রক্ষায় মুদাব্বিরকে বাড়িতে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেন। তাতে পত্রিকাগুলো সব সময় পাঠকদের নাড়াচাড়ার মধ্যে থাকলে সংরক্ষণের জন্যই ভালো।
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : মোঃ আফছর আহমদ
সম্পাদক ও প্রকাশক : মস্তাক আহমদ পলাশ
নির্বাহী সম্পাদক : নাজমুল কবীর পাভেল, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : উজ্জ্বল চৌধুরী।
মস্তাক আহমদ পলাশ কর্তৃক নিউ বর্ণমালা অফসেট প্রেস, রাজা ম্যানশন, জিন্দাবাজার, সিলেট থেকে মুদ্রিত ও ব্লু-ওয়াটার শপিং সিটি, ৯ম তলা (লিফটের-৮), জিন্দাবাজার, সিলেট থেকে প্রকাশিত।
ইমেইল : sylheterdinkalnews@gmail.com,
ফেইসবুক পেইজ : The Daily Sylheter Dinkal ০১৭১২৫৪০৪২০, ০১৭১১৯৮৪০৬৫, ০১৭১৮৫৩৮০৪৫ , ০১৭১১-৩২৬০৯১, শ্রীহট্ট মিডিয়া লিমিটেডের একটি প্রতিষ্ঠান।
Design and developed by best-bd