১০ই ডিসেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ | ২৫শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৮:১০ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৩, ২০১৬
তিন হাজার রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ * আশ্রয় নিচ্ছে অনিবন্ধিত ক্যাম্পে * বিজিবির অধিনায়ক অস্বীকার করলেও স্বীকার করেছেন ডিসি
সীমান্তে সতর্ক নজরদারি সত্ত্বেও বিজিবি, কোস্টগার্ড ও পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছেন রোহিঙ্গারা। ব্যাপক হারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশংকায় সীমান্তে সতর্কতা বৃদ্ধি করেছে বিজিবি। স্থানীয় জনগণের সহায়তা নিয়ে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কাজ করছে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ। তবুও রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়ে জীবন বাঁচাতে নিরাপত্তার সন্ধানে ঝুঁকি নিচ্ছেন রোহিঙ্গারা। যদিও বিজিবি এসব রোহিঙ্গার অনেককে পুশব্যাক করেছে। তবুও গত ২-৩ দিনে আনুমানিক প্রায় তিন হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন। একশ্রেণীর দালাল গোপনে অর্থের বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশে সহায়তা করছে। রোহিঙ্গাদের ঢুকানোর জন্য মাথাপিছু এক-দুই হাজার থেকে ২৫-৩০ হাজার টাকাও আদায় করা হচ্ছে। এসব রোহিঙ্গাকে তারা পাহাড়, জঙ্গল ও অনিবন্ধিত ক্যাম্পে নিয়ে রাখছে। তাদের কাছে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বর্বরতার ভয়াবহ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তারা বলছেন, সন্দেহ হলেই রোহিঙ্গাদের পাখির মতো গুলি করে হত্যা করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের বর্বরতা বন্ধে হস্তক্ষেপ না করলে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের আশংকা করা হচ্ছে। এএফপি, রয়টার্স, বিবিসিসহ বিদেশী সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, সেনা অভিযানের মুখে রাখাইন রাজ্য থেকে শত শত রোহিঙ্গা নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছেন। বাংলাদেশ ছাড়াও চীন, ভারতসহ আশপাশের দেশগুলোতেও রোহিঙ্গা ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। নিউইয়র্ক টাইমসের এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে মিয়ানমার সরকার।
জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থা (আইওএম) ঢাকা অফিসের সাবেক মুখপাত্র অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর মঙ্গলবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, গত ২-৩ দিনে তিন হাজারের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছেন বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে। এদের সামাল দেয়ার মতো তাৎক্ষণিক কোনো প্রস্তুতি বাংলাদেশের নেই। এটা থাকার কথাও নয়। এমন জরুরি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে ইউএনএইচআর কিংবা আইসিআরসির মতো সংস্থাগুলো। বাংলাদেশে ঢুকে পড়া রোহিঙ্গাদের বেশি ভেতরে ঢুকতে না দিয়ে কাছাকাছি কোনো একটা ক্যাম্প করে তাঁবুতে থাকতে দেয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, রাখাইন রাজ্যে মিডিয়া, ত্রাণকর্মী কাউকে ঢুকতে না দেয়ায় সেখানে কী ঘটছে সেটা বোঝা মুশকিল। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কিছুটা মনিটর করছে। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ট্রাম্প প্রশাসন ইস্যুটা দেখা উচিত। এখন পর্যন্ত এটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রূপ নেয়নি। কিন্তু নিপীড়ন চলতে থাকলে সেখানে জঙ্গিরা এই ঘটনাকে পুঁজি করে সেখানে ঢুকতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসন এ বিষয়ে মিয়ানমারের ওপর নির্যাতন বন্ধে চাপ দিতে পারে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র আগেই মিয়ানমারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে। বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা করা উচিত। আসিফ মুনীর মনে করেন, ঢাকায় আসন্ন অভিবাসনবিষয়ক জিএফএমডি সম্মেলনের সাইডলাইনে ভারত, চীনসহ আশপাশের দেশগুলো রোহিঙ্গা ইস্যুতে পৃথক বৈঠক করতে পারে। কেননা শুধু বাংলাদেশ নয়, সংকট জিইয়ে থাকলে তা ভারত, চীনসহ অন্য দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ ব্যাপারে মিয়ানমারকে বোঝানো যেতে পারে, দুর্বৃত্তরা সীমান্ত চৌকিতে হামলা করেছে। সাধারণ জনগণ হামলা করেনি। ফলে সাধারণ জনগণের ওপর নির্বিচারে বর্বরতা চালানো ঠিক নয়। উল্লেখ্য, ৯ অক্টোবর সীমান্ত চৌকিতে সমন্বিত হামলায় মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) নয়জন ও সেনাবাহিনীর পাঁচজন সদস্য নিহত হওয়ার জের ধরে রাখাইন রাজ্যে অভিযান শুরু করেছে সেনাবাহিনী।
মিয়ানমারের স্থল ও জলসীমান্তে নিয়মিত টহলের পাশাপাশি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), কোস্টগার্ড এবং পুলিশ অতিরিক্ত টহল থাকার পরও নিরাপত্তার সন্ধানে দলে দলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। গত কয়েক দিনে নিপীড়িত কয়েকশ’ রোহিঙ্গা টেকনাফের লেদা ও উখিয়ার কুতুপালংয়ের অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও আশ্রয় নিয়েছে।
রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের বিষয়টি কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান অস্বীকার করলেও জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কথা স্বীকার করে বলেছেন, প্রাণ রক্ষার্থে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কিছু রোহিঙ্গা ঢুকেছে বলে জানতে পেরেছি। তবে তার সংখ্যা কত তা জানা যায়নি।
মঙ্গলবার বিকালে কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তি ঘুরে দেখা যায়, আগে থেকে এখানে অবস্থান করা রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু বস্তি সংলগ্ন পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গা বস্তির বাসিন্দা আবু তৈয়ব জানায়, আমরাও নিপীড়িত হয়ে দেশ ছেড়েছি। তাই বিপদাপন্ন হওয়ার যন্ত্রণা বুঝি। রোববার ভোররাত থেকে বেশ কিছু রোহিঙ্গা প্রাণ নিয়ে সপরিবারে এসেছেন। অন্য দেশে অবৈধ আশ্রিত হলেও তাদের আমাদের সঙ্গেই থাকার ব্যবস্থা করেছি।
আবু তৈয়বের সহযোগিতায় অনুপ্রবেশকারী ১১ সদস্যের একটি রোহিঙ্গা পরিবারের সঙ্গে দেখা হয়। পরিবারপ্রধান মোহাম্মদ হাসেম (৩০) জানায়, তারা মংডু কেয়ারীপাড়ার বাসিন্দা। মিয়ানমার সেনা সদস্যরা তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়ায় প্রায় ২০ দিন ধরে বনজঙ্গলে লতাপাতা খেয়ে অবস্থান করি। প্রায় ৬ মাইল পাহাড়ি পথ হেঁটে নাফ নদী পর্যন্ত এসে নৌকায় উনচিপ্রাং সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকে কুতুপালং বস্তিতে এসেছি। স্ত্রী আরেফা বেগম (২৫), মেয়ে নুর কেয়াস (১০), ফায়সাল (৮), নইমা (৭), কবুরা (৫), কাবিনা আকতার (২), মা সবে মেরাজ (৫৫), ভাই জহিরুল ইসলাম (২৫), মোহাম্মদ রফিক (১৮) ও বোন সমুদা খাতুনকে (১৯) নিয়ে প্রাণে বেঁচে আসতে পারায় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে হাসেম বলেন, আমরা এখানকার (বাংলাদেশে) জন্য বোঝাস্বরূপ। কতটুকু অসহায় হলে মানুষ নিজ জন্মভিটা ছাড়ে তা আমাদের অবস্থানে না পড়লে কেউ বুঝবেন না। এখানকার সরকার কারাগারে দিলেও তো প্রাণে বাঁচব। ওখানে (আরাকানে) পাখির মতো গুলি ও পশুর মতো জবাই করে হত্যা করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার সকালে ক্যাম্পে আসা কামাল আহমদ (৪৫) জানান, কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তিতে মংডুর খিয়ারিপাড়ার ইসলাম (৭২), সিরাজুল ইসলাম (৭০), নুরুল কবির (৩৫), ফজল করিম (৩২), কবির (২৫), ইউনুছ (৪০), লুৎফুর নেছা (২৫), নুরুল আলম (৩০), খাইরুল আমিন (১৮), শামসুল আলম (৪০), আনিছুল্লাহ (৩০) ও আবদুল আমিনসহ (১২) তারা একসঙ্গে ৩৫ পরিবারের দেড় শতাধিক লোক একই সীমান্ত দিয়ে এপারে এসেছেন। তাদের মতে, প্রথমে তল্লাশি করে বাড়ির ব্যবহারের দা ও ধারালো অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে যায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও পুলিশ। এরপর তাদের ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। পথে যাকে পাচ্ছে গুলি করে মারছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে রাখাইন যুবকরা। তারা এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করেছে অনেক যুবক, তরুণী ও শিশুকে। তারা সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় রোববার রাতে নাফ নদীতে রোহিঙ্গা বোঝাই একটি নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে। এতে নারী-শিশুসহ ১০ জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানা গেছে। খবর পেয়ে টেকনাফের জাদিমুড়া এলাকার একটি ট্রলার নদীতে ভাসমান অবস্থায় ২০ জনের মতো রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে উদ্ধার করে। তবে নৌকায় থাকা শিশুসহ ১০ জন নিখোঁজের হসিদ মঙ্গলবার পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। নৌকাডুবির এ ঘটনায় রোকেয়া বেগম ও হুমায়ুন কবির দম্পতি বেঁচে গেলেও তার আনোয়ার ইব্রাহিম (৮), আফসান বিবি (৫) ও ইমরান (৩) নামে তিন সন্তান হারিয়ে দু’জনই পাগলপ্রায়।
অপরদিকে গত ৬ দিন আগে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ইদ্রিস নামে এক রোহিঙ্গাকে রোববার মধ্যরাতে আটক করেছে কক্সবাজার মডেল থানা পুলিশ। তিনি মিয়ানমারের আকিয়াব জেলার ভুচিদং গ্রামের বাটু মিয়ার ছেলে। রোববার তাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ছাড়পত্র দেয়ার পরপরই তাকে আটক করা হয়।
ইদ্রিস সাংবাদিকদের বলেন, ১২ নভেম্বর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর গুলিতে তিনি আহত হন। আহত অবস্থায় তিনিসহ তার গ্রামের পাঁচ শতাধিক লোক ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। তিনি নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম তুমব্রু সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে যান। সেখান থেকে মৌলভী ইয়াছিন নামে আরেক রোহিঙ্গার সহায়তায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি হন। তার সঙ্গে আসা অন্যরা কোথায় গেছে তিনি জানেন না।
তথ্যের সত্যতা স্বীকার করে কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তি ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি আবু ছিদ্দিক বলেন, গত এক সপ্তায় শতাধিক পরিবারের প্রায় হাজারের অধিক রোহিঙ্গা নতুন করে কুতুপালং বস্তিতে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের মাঝে নারী ও শিশুর আধিক্য বেশি। পুরুষের সংখ্যা কম। যারা এসেছে তাদের অনেকের পরিবারকর্তা নৃশংস হত্যার শিকার হয়েছেন।
আবু ছিদ্দিক আরও জানান, আরও কয়েক হাজার রোহিঙ্গা মঙ্গলবার ভোরে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তাদের উনছিপ্রাং সীমান্তে, হোয়াইক্যং ও বালুখালী চেকপোস্ট এলাকায় আটকে রেখেছে বিজিবি সদস্যরা। তিনি এখানে আনুমানিক ৫ রোহিঙ্গা থাকার খবর পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত উখিয়া সদর রাজাপালং ইউনিয়নের ৯ নম্বর কুতুপালং ওয়ার্ড সদস্য বখতিয়ার আহমদ বলেন, গত কয়েকদিনে কয়েক শতাধিক রোহিঙ্গা কুতুপালং বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানতে পেরেছি। বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকেও অবহিত করেছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আবুল খায়ের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ খবর পেয়েছেন স্বীকার করে বলেন, বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো হয়েছে। এখনও কোনো দিকনির্দেশনা আসেনি।
স্থানীয়রা জানিয়েছে, গভীর রাতে টেকনাফের লেদা, জাদিমুরা, রঙ্গিখালী, নয়াপাড়া, মৌলভীবাজার ও শাহপরীর দ্বীপ, খারাংখালী, ঝিমংখালী, কানজরপাড়া, লম্বাবিল, উলুবনিয়া, তুলাতলী, উনছিপ্রাং এবং উখিয়া উপজেলার আনজুমানপাড়া সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে নাফ নদী পার হয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসছে। কুতুপালং রেজিস্টার্ড ক্যাম্প ইনচার্জ আরমান শাকিল বলেন, তার ক্যাম্পে যেন অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
অপরদিকে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কথা অস্বীকার করে বলেন, ঘুমধুম, তুমব্রু ও বালুখালীসহ তার নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাটালিয়নের আওতায় থাকা বিওপি সদস্যরা মঙ্গলবার সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত ১১ পুরুষ, ২০ নারী ও ৩৫ শিশুসহ ৬৬ জনকে অনুপ্রবেশকালে আটক করে স্বদেশে ফেরত পাঠিয়েছে। অনুপ্রবেশ সম্পর্কে শরণার্থী ক্যাম্প সংশ্লিষ্ট ও অন্যদের দেয়া বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, বিজিবির সামনে দিয়ে কোনো অনুপ্রবেশ ঘটেনি।
অনুপ্রবেশ অব্যাহত আনরেজিস্টার্ড রোহিঙ্গা বস্তি এলাকায় : বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। অনুপ্রবেশকৃত রোহিঙ্গারা টেকনাফের নয়াপাড়া ও উখিয়ার কুতুপালং এলাকার আনরেজিস্টার্ড বস্তির টালকে টার্গেট করে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করছে। এমনকি গত কয়েকদিনে পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা এ শিবিরগুলোতে আশ্রয় নেয়ার খবর পাওয়া গেছে। এসব রোহিঙ্গার মধ্যে বিপুলসংখ্যক নারী ও শিশু রয়েছেন। দিন দিন অনুপ্রবেশের সংখ্যা বাড়তে থাকায় সীমান্ত এলাকার লোকজনের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। এ অবস্থায় সীমান্তে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের বিজিবি সদস্যরা। এরই মধ্যে মিয়ানমার সীমান্তে অতিরিক্ত বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে বলে বিজিবি সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
উখিয়ার সীমান্তে দায়িত্বে থাকা কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার জানান, রোববার রাত থেকে সোমবার বিকাল পর্যন্ত উখিয়ার বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেন ৩ শিশু, ১৩ নারী, ১৭ পুরুষসহ ৩৩ জন রোহিঙ্গা। তাদের বাধা দিয়ে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ১ নভেম্বর থেকে ২১ নভেম্বর বিকাল পর্যন্ত ১০৫ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।
টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুজার আল জাহিদ বলেন, ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় বিজিবি সদস্যরা ৮৬ জন রোহিঙ্গাকে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে পুশব্যাক করেছে। এদের মধ্যে ৪০ জন নারী ও ২৫ জন শিশুসহ ৮৬ জন ছিল। রোববার রাত থেকে সোমবার বিকাল পর্যন্ত নাফ নদী ও টেকনাফের উনছিপ্রাং, ঝিমংখালী, হ্নীলা, হোয়াইক্যংসহ চারটি সীমান্ত এলাকার প্রতিটি পয়েন্ট দিয়ে পাঁচ-ছয়টি নৌকায় বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টার সময় (প্রতিটিতে ১০-১২ জন) রোহিঙ্গাদের প্রতিহত করা হয়েছে। এর মধ্যে হোয়াইক্যং সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ৩৮ জনকে বাধা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বিজিবি সদস্যদের বাধার মুখে অনুপ্রবেশ করতে না পেরে তারা বাধ্য হয়ে মিয়ানমারে ফিরে যায়।
এদিকে টেকনাফের হোয়াইক্যং সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের অভিযোগে ৭৯ জন রোহিঙ্গাকে আটক করেছে বিজিবি। সোমবার সন্ধ্যা ৭টায় হোয়াইক্যং লম্বাবিল সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় নাফ নদীতে ৪১ জন ও বিকাল সাড়ে ৩টায় হোয়াইক্যং চেকপোস্টে ৩৮ জনকে বিভিন্ন যানবাহন তল্লাশি চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। বিজিবি হোয়াইক্যং কোম্পানি কমান্ডার নায়েব সুবেদার ইব্রাহিম জানান, মঙ্গলবার সকালে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। আটককৃতদের মধ্যে ২৬ নারী, ১৮ পুরুষ, ৩৫ জন শিশু রয়েছে।
টেকনাফের উনছিপ্রাং সীমান্তকে নিরাপদ মনে করছে রোহিঙ্গারা : টেকনাফের উনছিপ্রাং সীমান্তকে নিরাপদ মনে করে বেশির ভাগ রোহিঙ্গা এদিকেই ঢোকার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। উখিয়া ও টেকনাফ এলাকার রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক চিহ্নিত কিছু আদম পাচারকারী দালাল মোটা অংকের বিনিময়ে আদম পাচার বাণিজ্যে মেতে উঠেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া সীমান্ত এলাকায় রয়েছে তাদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক।
নুরুল করিম রাসেল, টেকনাফ থেকে জানান, টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি বান্দরবানের জেলার নাইক্ষংছড়ি উপজেলার ঘুংধুম সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ হচ্ছে বলে জানা গেছে। সীমান্তে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের কঠোর নজরদারির পরও অনুপ্রবেশ ঠেকানো যাচ্ছে না।
সোমবার রাতে ও মঙ্গলবার ভোরে টেকনাফের অন্তত ১২টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে শত শত রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। প্রাণভয়ে ভীত রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে সহায়তা করছে স্থানীয় দালালরা। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে দালালরা রাতের আঁধারে নৌকা পাঠিয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসছে। দালালরা সীমানা পার করিয়ে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার।
যেসব সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ ঘটছে : টেকনাফ সীমান্তের হোয়াইক্যং উলুবনিয়া, বালুখালী, লম্বাবিল, কাঞ্জরপাড়া, ঝিমংখালী, খারাংখালী, উনছিপ্রাং, হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমুড়া, নয়াপাড়া, নাথমুড়াপাড়া, গুদামপাড়া, ফুলের ডেইল, হোয়াব্রাং, নাইক্ষ্যংখালী, আনোয়ার প্রজেক্ট, লেদা ও দমদমিয়া পয়েন্ট দিয়ে রাতের আঁধারে অনুপ্রবেশের এ ঘটনা ঘটছে। সবচেয়ে বেশি অনুপ্রবেশ ঘটছে হোয়াইক্যং কাঞ্জরপাড়া, ঝিমংখালী ও হ্নীলা জাদিমুড়া দিয়ে।
মিয়ানমারের যেসব এলাকা থেকে রোহিঙ্গারা আসছে : মিয়ানমারের মংডু থানার গৌজিবিল, রাইম্যাবিল, জাম্বনীয়া, বুড়া সিকদারপাড়া, আলী আকবরপাড়া, কাইমপেরাং, খাইয়ংখালী, খিয়ারীপাড়া, শিলখালী, কুমিরখালীসহ বেশ কয়েকটি এলাকা থেকে এসব রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে।
জাদিমুড়া পয়েন্টে দালাল : আবদুল আমিন, নুরুল ইসলাম, উসমান গনি, নূর কামাল, মো. তৈয়ুব, কামাল হোসেন, আবুল ফয়েজ (বার্মায়া), নুর হাসিম গুন্ডায়া, বদি আলম, আবদুল জলিল, আয়ুব খান, ইউসুফ, খাইরুল বশর। নয়াপাড়া পয়েন্ট শফিকুর রহমান, আমির হামজা, হাবিবউল্লাহ, জালাল, ফজিউল্লাহ।
দমদমিয়া : সোনা মিয়া, লেদা পয়েন্ট-জসিম, জাহাঙ্গীর, জাফর, সরওয়ার আলী খালী-মোহাম্মদ মিয়া, হোয়াইক্যং কোনাপাড়া-মোস্তাফিজ, হেলাল, জসিম উদ্দিন, তোফায়েল, সাহাবুদ্দিন, উনছিপ্রাং-আমির হোসেন, কুতুবদিয়া পাড়া-এবাবদুল্লাহ, আবছার, জাহাঙ্গীর, শামসু আলম, জামাল, ওসমান, মিনাবাজার-হামিদ, রফিক, মফিজ আহমদ, কামাল, রাসেল, মন্নান, মিজান, জাহাঙ্গীর, মোস্তাক।
ঝিমংখালী : জসিম উদ্দিন, জালাল, শাহজাহান, মো. মিজান, মিজানুর রহমান, মো. আমিন, মোবারক মিয়া, আলী হামদ, মো. কামাল।
কাঞ্জরপাড়া : নুরুল আমিন, নুরুল আলম, জাহেদ হোসেন, ইব্রাহিম, হেলাল উদ্দিন, জাফর আলম, মুজাম্মেল, শেখ কামাল, সেলিম, কবির আহমদ, জসিম উদ্দিন, মো. রফিক।
হোয়াইকং লম্বা বিল : নুরুল বসর, আয়ুব, সলিম, জাফর আলম, মমতাজ, লালু, ফরিদ আলম, আয়াছ, নুর হোসেন, ফজল, ছৈয়দ হোসেন।
বিজিবি-বিজিপির অনানুষ্ঠানিক বৈঠক আজ : রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) আঞ্চলিক কমান্ডার পর্যায়ে কক্সবাজারে বৈঠক হবে আজ। বিজিবি বলছে, বৈঠকটি অনানুষ্ঠানিক এবং বিজিপির আঞ্চলিক কমান্ডারের সফর উপলক্ষে এ বৈঠক হবে। তাদের আগ্রহ থাকলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশংকার ইস্যুটি আলোচনায় তোলা হবে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের (চট্টগ্রাম) কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খন্দকার ফরিদ হাসানের আমন্ত্রণে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) আঞ্চলিক কমান্ডার সন লুইন বুধবার সকালে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আসবেন। সন লুইন গত মাসে মিয়ানমারের ওই অঞ্চলের দায়িত্ব নিয়েছেন। গত মাসেই তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য একটি চিঠি দেয়া হয়। গত সপ্তাহে সন লুইন বিজিবির রিজিয়ন কমান্ডারকে জানিয়েছেন, তিনি টেকনাফ এবং কক্সবাজার পরিদর্শন করতে চান।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফরিদ হাসান বলেন, ‘তার প্রস্তাবে আমরা সম্মতি দিয়েছি। এটি সৌজন্য সাক্ষাৎ। এর এজেন্ডা আগে থেকে নির্ধারিত হয়নি। বর্তমান প্রেক্ষিতে আলোচনা হতেও পারে। এটি নির্ভর করবে তাদের ইচ্ছার ওপর। সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, বর্তমানে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের আশংকা অনেক বেশি। এর জন্য আমরা বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছি।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মস্তাক আহমদ পলাশ
সহ-সম্পাদক : জুমা কবীর মীম
নির্বাহী সম্পাদক : নাজমুল কবীর পাভেল
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : উজ্জ্বল চৌধুরী।
মস্তাক আহমদ পলাশ কর্তৃক নিউ বর্ণমালা অফসেট প্রেস, রাজা ম্যানশন, জিন্দাবাজার, সিলেট থেকে মুদ্রিত ও অনামিকা এ/৩৪ পূর্ব শাহী ঈদগাহ, সিলেট থেকে প্রকাশিত।
ইমেইল : sylheterdinkalnews@gmail.com,
ফেইসবুক পেইজ : The Daily Sylheter Dinkal ০১৭২২১৮৮৫৫১, ০১৭৫৫৮৬৬২২২, ০১৭১২৫৪০৪২০, শ্রীহট্ট মিডিয়া লিমিটেডের একটি প্রতিষ্ঠান।
Design and developed by M-W-D