বাংলাদেশে সন্ত্রাসের মোকাবিলায় যা জরুরি

প্রকাশিত: ৯:৫৫ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ৫, ২০১৬

বাংলাদেশে সন্ত্রাসের মোকাবিলায় যা জরুরি

25796_andগত ১৮ মাস ধরে বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার মানুষ, ধর্মগুরু, সমকামী অধিকার আন্দোলনকর্মী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপর একের পর এক আঘাত নেমে আসছিল। কিন্তু প্রবাসী ও অভিজাতদের পছন্দের ক্যাফে হলি আর্টিজান বেকারিতে গত ১ জুলাই জঙ্গি হামলার ঘটনা সব বাস্তবতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। এ ঘটনার পর ঢাকার অধিকাংশ বাসিন্দাই মনে করছেন, তাঁদের প্রিয় এই নগরী আর কখনওই আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে না।
আর্টিজানে হামলায় অভিযুক্ত পাঁচ তরুণের মধ্যে তিন জনই ঢাকার সচ্ছল পরিবারের সন্তান। লেখাপড়া করেছে বেসরকারি স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিন জন এসেছে সচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। তারা বিশেষ সুবিধাভোগী এবং বেসরকারি ভাবে বাংলাদেশ ও বিদেশে শিক্ষিত। সন্ত্রাসীদের জন্য আমরা যে প্রোফাইল তৈরি করেছি, তা হল অনেকটা এ রকম: তারা গরিব, গ্রামের ছেলে, মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। কিন্তু আর্টিজানে হামলাকারীদের ক্ষেত্রে এই প্রোফাইল মিথ্যা প্রমাণিত হল। কারণ তাদের প্রয়োজনীয় সব কিছুই ছিল, কোনও অভাব-অনটন ছিল না। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীতে যোগ দেওয়ার ঘটনা এই প্রথম নয়, কিন্তু তাদের এ ভাবে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়ার ঘটনা এই প্রথম। আবার হামলাকারীদের দু’জন অপেক্ষাকৃত কম সচ্ছল পরিবার থেকে এসেছে, এটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এতে বোঝা যায়, জঙ্গি দলগুলো দরিদ্রদের মধ্য থেকেও সমর্থন পাচ্ছে।
বাংলাদেশের আইএস সম্পূর্ণ রূপে কোনও নতুন দল নয়। বহিরাগত দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে স্থানীয় কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর যোগফল। আইএসের যোগসূত্র সম্ভবত ইতোমধ্যে উপস্থিত হুমকিকে বাস্তব রূপ দিয়ে অস্তিত্বের জন্য হুমকি তৈরি করে তুলেছে। সিরিয়া গিয়ে প্রশিক্ষিত হওয়ার আশঙ্কা ও তার রোমাঞ্চ তরুণদের ঝুঁকি নেওয়ার প্রেরণা দিয়েছে। আইএসের সঙ্গে স্থানীয় জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করতে সরকারের প্রচেষ্টা আশঙ্কাজনক। সমস্যা শনাক্ত করতে না পারলে তার সমাধানও সম্ভব নয়। উগ্র ইসলামপন্থীরা চাতুর্যের সঙ্গে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে অভিযোগ তুলে যাচ্ছে যে, পশ্চিমে মুসলমানরা প্রবল ভাবে দমিত হয়ে আছে, দেশে দুর্নীতি ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এই কথার একটা প্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করলেও কিছু মানুষ এমনও ভাবতে পারে, এই হামলার ‘যুক্তি’ রয়েছে।
এখানে দেখতে হবে, প্রাথমিক ভাবে জিহাদের ডাক জায়েজ করা হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতার অভিযোগে। এ কারণেই ইসলামের বক্তব্য ও তার বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই সংকটের মোকাবিলা জরুরি। এ ক্ষেত্রে পরমবাদী আদর্শ কী ভাবে তারুণ্যের আদর্শবাদী স্পৃহাকে নিজের স্বার্থে কাজ করতে বাধ্য করে, তা বোঝা প্রয়োজন। তরুণ প্রজন্ম যদি এক বার ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে হত্যার পথে এগিয়ে যায়, তবে তাকে দ্রুত ফেরানো সম্ভব নয়। আগের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের তুলনায় আজকের চ্যালেঞ্জ আরও বেশি, কারণ ধর্মীয় বিশ্বাসের শক্তি মানুষকে আরও প্রত্যয়ী করে তোলে। সামাজিক মাধ্যমের সম্ভাবনা এ ক্ষেত্রে নেটওয়ার্কিং টুল ও মগজ ধোলাইয়ের পাটাতন হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা সংকটকে ভিন্ন মাত্রা দেয়।
সমস্যাটি হল, একটি ক্ষমতাবান গোষ্ঠী এক ধরনের আদর্শ স্থাপনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে চায়। এই পদ্ধতি অন্য সময়ে বিভিন্ন স্থানে সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশে এই আদর্শ স্থাপনের সুফল সবচেয়ে বেশি ভোগ করবে জামায়াতে ইসলামি ও তার দোসররা। জামায়াত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। এখনও ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে গিয়ে শরিয়া প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। অনেক দিন ধরেই দলটির সশস্ত্র কর্মী রয়েছে। তরুণ সদস্যরা নতুন সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বিকশিত হওয়ার উর্বর ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছে।
এই জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রভুদের পরিষ্কার লক্ষ্য: একটা মতাদর্শ ব্যবহার করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা, যেখানে জনসংখ্যার অংশবিশেষের বিশ্বাস অর্জনের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের নিয়োগ দেওয়া হবে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে আমি এমন মন্তব্য দেখেছি যে, পশ্চিমা কর্তৃত্ব, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং অন্যান্য কারণ খুনিদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকতে পারে। যেন এ ধরনের একটা নারকীয় তাণ্ডবের পেছনে এগুলো বৈধ ভিত্তি। আমাদের এ বিষয়ে পরিষ্কার হতে হবে যে, এ সবের কোনও বৈধ ভিত্তি নেই, থাকতে পারে না।
আর্টিজানে নারকীয় হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে জঙ্গিরা ঢাকার বাসিন্দাদের নিরাপত্তাবোধ ছিনিয়ে নিয়েছে— সব জায়গায় অনুরাগী ও পরিচিতজনরা হত্যাকাণ্ডের একটি সম্ভাব্য দৃশ্যপট কল্পনা করছেন। তারা জাতির গভীরতম আস্থাও ছিনিয়ে নিয়েছে। এই হামলার মধ্য দিয়ে এমন একটা সন্দেহ সৃষ্টি করা হয়েছে যে, আমাদের তরুণরা বিভ্রান্তিপ্রবণ হয়, তারা অন্য যে কারও দ্বারা অতিমানবীয় কল্পনায় আক্রান্ত হওয়া থেকে সুরক্ষিত নয়।
সরকারের এখন করণীয় একটাই— তার সন্ত্রাসবিরোধী প্রচেষ্টা সর্বতোভাবে বাড়ানো। অতীতের যে কোনও সহিংস আন্দোলনের মতো আজকের জঙ্গি কর্মকাণ্ডও প্রতিহত করা যেতে পারে, কিন্তু সেটা খুব সহজ নয়। এ কাজে সরকারকে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। তবে, আমাদের অবশ্যই কঠোর নজর দিতে হবে— কী ভাবে নিজেদের ও অন্যদের সম্পর্কে কথা বলব?
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বার বার ধর্মের সঠিক ও মানবিক ব্যাখ্যা এবং তরুণদের সুশিক্ষা ও পারিবারিক বন্ধনের ব্যাপারে বক্তব্য পেশ করেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা এখন চোখে পড়ার মতো। উস্কানিমূলক বক্তব্যের কারণে জাকির নায়েকের ‘পিস টিভি’ বাংলাদেশে বন্ধ করা হয়েছে। জনগণ এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। এ সবই সুলক্ষণ। তবে এটা যথেষ্ট নয়। আমাদের নিরাপত্তার সামর্থ্য আরও অনেক বাড়াতে হবে। এরই মধ্যে দেরি হয়ে গেছে, অনেক দেরি। এখনই শুরু করতে হবে।
(লেখক: বাংলাদেশে ঢাকা ট্রিবিউন, বাংলা ট্রিবিউন এবং বেঙ্গল লাইটস-এর প্রকাশক)

সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা

ফেসবুকে সিলেটের দিনকাল