বিদায় ১৪২২ বঙ্গাব্দ, আজ বাংলা বর্ষের সমাপনী দিন

প্রকাশিত: ৮:৩৯ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১২, ২০১৬

বিদায় ১৪২২ বঙ্গাব্দ, আজ বাংলা বর্ষের সমাপনী দিন

64811_1আজ ৩০ চৈত্র বুধবার। নানামুখী অস্থিরতার মধ্যেও কালের নিয়মে চিরবিদায় নিচ্ছে ১৪২২ বঙ্গাব্দ। বাংলা বর্ষের সমাপনী দিনটি ‘ চৈত্র সংক্রান্তি’ নামেও সমধিক পরিচিত। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার তথা আন্তর্জাতিকতাবাদের দোর্দ- প্রতাপে জাতীয় জীবনে বাংলা পঞ্জিকা ততোটা গুরুত্ব না পেলেও সাংস্কৃতিক কারণে এর তাৎপর্য ঢের বেশি। একটি বিশেষ উপলক্ষ হিসেবে গণ্য কিংবা নতুন বছরকে আহ্বান করে বলে চৈত্রের মর্যাদা স্বীকৃত হয়ে আছে। খরতাপের দাপটে ‘প্রাণ যায় যায়’ করা গরম কিংবা বর্ষ বিদায়ের করুণ রাগিনীর চেয়ে বিমূর্ত হয়ে ওঠে নতুন বছরের আগমনী আয়োজন। দিকে দিকে তাই এখন চৈত্র সংক্রান্তি উৎসবের আমেজ, গোটা জাতি সাড়ম্বরে ১৪২৩ বঙ্গাব্দকে বরণ করে নিবে। এ উপলক্ষ্যে নগর জুড়ে চলছে বর্ষবরণের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি।

কবির ভাষায়-‘জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক, মুছে যাক গ্লানি…।’ মহাকালের অতল গর্ভে হারিয়ে যাবে আরও একটি বাংলা বছর। সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদায়ী বছরের সমস্ত চাওয়া পাওয়া, হতাশা ও অপ্রাপ্তির সাঙ্গ হবে। নতুন সূর্যোদয়ে, নতুন দিনের প্রভাতে সুন্দর, উজ্জ্বল আগামীর কামনায় কাতর হবে সকলে। ইংরেজি বছরে গণমাধ্যমে সালতামামি নিয়ে বিশেষ আয়োজন থাকলেও বাংলা বছর সমাপনান্তে সে ধরনের আয়োজন একদমই থাকে না। তবে এবার বিদায়ী বাংলা বর্ষে পান্তা-ইলিশ, মুখোশ আর ভুভুজেলা (এক ধরনের বিদেশী বাঁশী) বর্জনের গণডাকের বিষয়টি ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দফতর থেকেও গতকাল মঙ্গলবার বর্ষবরণ আয়োজনের মেনুতে ইলিশ থাকছে না বলে গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছে।

আমাদের দেশের হিন্দু সম্প্রদায় বরাবরের মতো এবারো একদিন পিছিয়ে আগামীকাল বৃহস্পতিবার চৈত্র সংক্রান্তির দিন ও উৎসব পালন করবে। তারা ভারতবর্ষে প্রচলিত শকাব্দ পঞ্জিকা তথা নিজেদের শাস্ত্রীয় পঞ্জিকা অনুসরণ করে বলে পহেলা বৈশাখ পালনেও বিভক্তি রয়েছে। বাংলাদেশে প্রচলিত ও মান্য একমাত্র বাংলা একাডেমির পঞ্জিকা হিসেবে যখন বৈশাখের সূচনা দিন, হিন্দু সম্প্রদায়ের তখন চৈত্র সংক্রান্তি। দীর্ঘদিন ধরে এ প্রথা চলে আসায় বিশেষ করে হিন্দু ব্যবসায়ীদের বার্ষিক লেনদেনের হিসাব চুকানোর এ সংস্কৃতি রাষ্ট্রীয় পঞ্জিকার ব্যত্যয় ঘটালেও তাই এখনো স্বাভাবিক রীতি হিসেবেই গণ্য হচ্ছে।

পুরানো কাল ধরে বাংলা বছরের সমাপনী মাস চৈত্রের শেষ দিনটিকে হিন্দু সম্প্রদায় ‘চৈত্র সংক্রান্তি’ পালন করছে। লৌকিক আচার অনুযায়ী এ দিনে বিদায় উৎসব পালন করে বিশেষ ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। দোকানপাট ধুয়ে-মুছে বিগত বছরের যতো সব জঞ্জাল, অশুচিতাকে বিদূরিত করা হয়। পরদিনই খোলা হবে ব্যবসায়িক হিসাব-নিকাশের নতুন খাতা। সে উৎসবের লোকায়ত নাম ‘হালখাতা’। এদিকে সরকারি বাংলা পঞ্জিকাকে এড়িয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা, ‘লোকনাথ পঞ্জিকা’ নামে এক বিশেষ ধরনের পঞ্জিকা অনুসরণ করতে গিয়ে চৈত্র সংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ উভয়ই একদিন পর পালন করছে।

এ বিষয়ে বাংলা একাডেমির ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও পত্রিকা বিভাগের সাবেক পরিচালক এবং তৎকালীন বাংলা বর্ষপঞ্জিকা সংস্কার কমিটির সদস্য সচিব ওবায়দুল ইসলাম বলেন, প-িতজনদের শলা পরামর্শের ভিত্তিতে জ্যোতির্বিদ্যা ও ইংরেজি সালের সাথে যতদূর সম্ভব মিল রেখেই বর্তমান বাংলা পঞ্জিকা প্রণীত হয়েছে। এটি বিজ্ঞানভিত্তিক ও সার্বজনীন বঙ্গাব্দ পঞ্জিকা। এ পঞ্জিকা অনুযায়ী যে বছর ইংরেজি সালের ফেব্রুয়ারি মাস লিপইয়ার বা অধিবর্ষ হয়, একই বছরে বাংলা বছরের ফাল্গুন মাস অধিবর্ষ হয়। এ হিসেবে অধিবর্ষ ফেব্রুয়ারি মাস ২৯ দিনের প্রভাবে ফাল্গুন মাস ১ দিন বেড়ে ৩১ দিনে হয়।

তিনি আরো বলেন, যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা দ-পল মানে তারা লোকনাথ পঞ্জিকা অনুসরণ করে। তবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হিন্দু অধ্যুষিত হলেও সেখানে একাধিক পঞ্জিকা ব্যবহৃত হয়। তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার বাংলা একাডেমির বর্ষ পঞ্জিকাকে স্বীকৃতি দেয়। এ বর্ষ পঞ্জিকা প্রণয়নের কয়েক বছর পর্যন্ত দৈনিক ইত্তেফাকও তা অনুসরণ করেনি।

বিশিষ্ট লোকবিজ্ঞানী ড. আশরাফ সিদ্দিকী বলেন, হিন্দু সম্প্রদায় জাতীয় মূল্যবোধের চেয়ে শাস্ত্রীয় বিশ্বাসকে বেশি মূল্য দেয়। তারা তিথি-নক্ষত্রের হিসাব করে। তাই তারা রাষ্ট্রীয় বর্ষপঞ্জিকাকে অবজ্ঞা করে চৈত্র সংক্রান্তি ও বর্ষবরণ উৎসব পালন করে। অবশ্য এতে তেমন কিছু যায়-আসে না।

বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক রশীদ হায়দার চৈত্রসংক্রান্তি প্রসঙ্গে বলেন, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায় চৈত্রসংক্রান্তির উৎসবটি নানা পুজো অর্চনার মধ্যদিয়ে পালন করে থাকেন। সূর্যের কৃপা প্রার্থনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের কৃষককুল পুরো চৈত্রমাস জুড়েই পালন করে প্রার্থনা উৎসব। হিন্দু ব্যবসায়ীরা আয়োজন করে চড়ক পুজোর।

তিনি বলেন, চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে লোকমেলার আয়োজন গ্রাম-গঞ্জেই বেশি হয়। মেলা, গান-বাজনা, যাত্রাপালাসহ নানা আয়োজনে উঠে আসে লোকজ সংস্কৃতির নানা সম্ভার। অনেক জায়গায় ইতোমধ্যে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা বসে গেছে। সে দিক থেকে শহরাঞ্চলে চৈত্রসংক্রান্তির চিরন্তন আবেদন বলতে গেলে তেমন নেই, গান-বাজনার কিছু অনুষ্ঠান ছাড়া।

চৈত্রসংক্রান্তির অনুষ্ঠান: প্রতি বছরের মতো এবারও বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন জাতীয় নাট্যশালার এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে আজ সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায় চৈত্রসংক্রান্তির বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে বর্ষবিদায়ের সূচনা সঙ্গীতের মধ্যদিয়ে শুরু হবে অনুষ্ঠান। প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও বর্ষবিদায়ের শুভেচ্ছা বক্তৃতা দেবেন সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা। থাকবে শিল্পী শাহাদাৎ হোসেন খানের সেতারবাদন। অনুষ্ঠানে নাটকের শিল্পীরা পরিবেশন করবেন গান। আলোচনা ও গানের ফাঁকে ফাঁকে চলবে আবৃত্তি। এছাড়া বাঙালির ঐতিহ্যবাহী শুকনো খাবার মুড়িÑমুরকীর আয়োজনও রেখেছে ফেডারেশন।

বর্ষবিদায় উপলক্ষে রাজধানীর শেরেবাংলানগরস্থ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে চৈত্রসংক্রান্তি উৎসবের আয়োজন করেছে সুরের ধারা। বিকেল সাড়ে ৫টায় শুরু হয়ে অনুষ্ঠানটি চলবে রাত ১২টা ১ মিনিট পর্যন্ত। চ্যানেল আই পুরো অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করবে। সবার জন্য উন্মুক্ত এ অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছেন সুরের ধারার রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা।

ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন: ‘বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন’ বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও রূপসী বাংলার রূপ নিয়ে একটি আলোকচিত্র প্রদশর্নীর আয়োজন করা করেছে, বুধবার ( ১৩ এপ্রিল), সকাল ১১ টায় ৫৮/১/এ, পুরানা পল্টন ঢাকা।(বাইতুল মোকারম মসজিদের উত্তর গেটের বিপরীতে)।

ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর কালচারাল ক্লাবের উদ্যোগে বাংলা বছর ১৪২২ সালকে বিদায় ও ১৪২৩ সালকে স্বাগত জানাতে দু’দিনব্যাপী ‘চৈত্রসংক্রান্তি উৎসব’ গতকাল শেষ হয়েছে। এ উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত। উৎসবে নাচ, গান, আবৃত্তির পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন পদের পিঠা ও মৃৎপণ্য সামগ্রীর স্টল সাজিয়ে বসে।