রোগীদের হয়রানীর নাম ডায়গনস্টিক সেন্টার

প্রকাশিত: ৯:৪৩ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৪, ২০১৬

রোগীদের হয়রানীর নাম ডায়গনস্টিক সেন্টার

নিজস্ব প্রতিবেদক:: ভুল রিপোর্ট দেওয়া, একজনের রিপোর্ট আরেজনের সাথে গুলিয়ে ফেলা, উচ্চ ফি নেওয়া- সিলেট নগরীর ডায়গনস্টিক সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ বেশ পুরনো। প্রায় প্রতিদিনই রোগী ও তাদের স্বজনদের কাছ থেকে পাওয়া যায় এসব অভিযোগ।
তবে এবার নগরীর রোগ নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে আরো গুরুতর অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে ভ্রাম্যমান আদালত। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়াই টেকনিশিয়ান দিয়ে প্যথলজিক্যাল পরীক্ষার রিপোর্ট প্রদান, চিকিৎসকের স্বাক্ষর জাল করে রিপোর্ট প্রদান, মেয়াদোত্তীর্ন ও অপিরচ্ছন্ন সরঞ্জামাদি দিয়ে পরীক্ষা- এমন গুরুতর সব অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে আদালত।
গত দুই দিনে নগরীর অন্তত ডায়গনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালিয়ে প্রায় ২৭ লাখ টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমান আদালত। সিলগালা করা হয় একটি ডায়গনস্টিক সেন্টারকে।
ভ্রাম্যমান আদালতের এসব অভিযানের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, রোগ নির্ণয়ের নামে কী হচ্ছে ডায়গনস্টিক সেন্টারগুলোতে?

এ ব্যাপারে সিলেটের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক গৌরমনি সিনহা বলেন, নগরীর বেশিরভাগ রোগ নির্ণয়কারী প্রতিষ্টানই নূন্যতম মান বজায় রাখতে পারে না। তাছাড়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও টেকনিশিয়ানেরও স্বল্পতা আছে। অনেকেই একাধিক ক্লিনিক ও ডায়গনিস্টক সেন্টারের সাথে জড়িত। ফলে সব সময় সব ডায়গনস্টিক সেন্টারে গিয়ে চিকিৎসকদের পাওয়া যায় না।

তিনি বলেন, আমরা তাদের একটি নূন্যতম মানের মধ্যে নিয়ে আসতে চেষ্টা চালাচ্ছি। সবসময় মনিটরিং করছি। মান দেখভালের জন্য সিটি করপোরেশন এলাকায় একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটিও রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে রোগনির্ণয় প্রতিষ্ঠানগুলো যে মানের হওয়া উচিত বেশিরভাগই সে মানে নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, সিলেট বিভাগে প্রায় দুইশ’টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এরমধ্যে সিলেট নগরীতেই রয়েছে ৬০ টি ডায়গনস্টিক সেন্টার। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেবের বাইরে অনুমোদন ছাড়াই আরো অনেক ডায়গনস্টিক সেন্টার নগরীতে ব্যবসা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

তবে নগরীর এসব ডায়গনস্টিক সেন্টারগুলোর বেশিরভাগেরই কোনো পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই বলে জানান পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি জানান, হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পরিবেশ অধিদপ্তরে ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছে।

তবে এ ব্যাপারে নগরীর এবিসি ডায়গনস্টিক সেন্টারের সত্ত্বাধিকারী দেবাশীষ দে বাসু বলেন, সব ডায়গনস্টিক সেন্টারেই ইসিজিসহ কিছু পরীক্ষা টেকনিশিয়ানরাই করে থাকে। এমনকি ওসমানীসহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের সরকারী হাসপাতালগুলোতেও টেকনিশিয়ানরা অনেক টেস্ট করে থাকেন।

শতভাগ সঠিকভাবে কোনো কিছুই চালানো সম্ভব না জানিয়ে নগরীর কাজলশাহ এলাকার একটি ডায়গনস্টিক সেন্টারের সত্ত্বাধিকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একটি ট্রেন্ড হয়ে গেছে ভ্রাম্যমান আদারত কোনো প্রািতষ্ঠানে ঢুকলেই জরিমানা করবে। একটা না একটা অনিয়ম খুঁজে বের করা হবেই।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেবের বাইরে আরো অনুমোদতন ছাড়াই আরো অর্ধশতাধিক ডায়গনস্টিক সেন্টার নগরীতে ব্যবসা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এসব ডায়গনস্টিক সেন্টারের ব্যাপারে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সরওয়ার আলম বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসক ছাড়াই টেকনিশিয়ান দিয়ে পরীক্ষা করানো হচ্ছে। একজন চিকিৎসকের নামে ছয় রকমের স্বাক্ষরও পেয়েছি। এছাড়া সবখানেই মেয়াদ উত্তীর্ন সরঞ্জামাদি ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব সরঞ্জামাদি ব্যবহার করে সঠিক রিপোর্ট তো আসবেই না বরং রোগীরা আরো রোগাক্রান্ত হবেন।
শনিবার এমন গুরুতর অনিয়মের প্রমাণ পেয়ে নগরীর ৪ টি ডায়গনেস্টিক সেন্টারকে ১৫ লাখ টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমান আদালত। এছাড়া একটি ডায়গনেস্টিক সেন্টারকে সিলগালা করা হয়েছে।
শনিবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা সোয়া ৭ টা পর্যন্ত নগরীর পুলিশ লাইন ও স্টেডিয়াম মার্কেটের বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এ অভিযান চালায় র‌্যাব-৯ পরিচালিত ভ্রাম্যমান আদালত। রমধ্যে শাহজালাল মেডিকেল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে ৮ লাখ টাকা, ন্যাশনাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে ৪ লাখ টাকা, দি প্যাথলজি ল্যাব এন্ড ডায়াগনস্টিক ও নিরাময় ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে দেড় লক্ষ টাকা করে জরিমানা করা হয়।
এসময় নিউ ইবনেসিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিলগালা করে দেওয়া হয়। র‌্যাব-৯ এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম এর নেতৃত্বে ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিলেট অফিসের সহযোগীতায় এ অভিযান পরিচালনা করা হয়।
অভিযানকালে ডায়গনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার রির্পোটে চিকিৎসকের স্বাক্ষর জালিয়াতি ও মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ ব্যবহারের অপরাধে ন্যাশনাল ডায়াগনস্টিক ও এরকম অনিয়মের কারণে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও জরিমানা করেন আদালত।
এর আগে গত ১ ডিসেম্বর চিকিৎসকের পরিবর্তে অদক্ষ লোক দিয়ে সিটিস্ক্যান ও ইসিজি করার দায়ে সিলেটে মেডিনোভা মেডিক্যাল সার্ভিস ও হেলথ কেয়ার ক্লিনিক, ফার্মেসিসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ১২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছিল।

অভিযান শেষে র‍্যাব-৯ এএসপি পিযুষ চন্দ্র দাস বলেন, মেডিনোভা হেলথ কেয়ার ক্লিনিকে সিটিস্কেন ও ইসিজি’র মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ছাড়াই করা হচ্ছে। ডাক্তারের পরিবর্তে অদক্ষ কর্মচারীরা এসব পরীক্ষার কাজ করছে। আরমেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ বিক্রির অপরাধে ফার্মেসী ২টি কে জরিমানা করা হয়।

এছাড়াও আরো কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল ডায়াগনষ্টিক সেন্টারকে মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয় বলে জানান তিনি। জরিমানাকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মেডিনোভা ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে ৪ লাখ টাকা, হেলথ কেয়ার হসপিটালকে ২ লাখ টাকা, জননী ফার্মেসীকে ২৫ হাজার টাকা ও মেডিকম ড্রাগ হাউজকে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

ফেসবুকে সিলেটের দিনকাল