শুনতে পাই হাকালুকির হাহাকার—-শরীফ আহমেদ

প্রকাশিত: ১২:১২ অপরাহ্ণ, জুন ১, ২০১৬

শুনতে পাই হাকালুকির হাহাকার—-শরীফ আহমেদ

pic sharif0000-000হাকালুকি। এই একটি মাত্র শব্দের সাথে যে মিশে আছে কত-শত সাতকাহন আর মানুষের জীবন সংগ্রামের গল্প তার কোন হিসেব নেই। প্রতিদিন শত শত মানুষ এই হাওরকে ঘিরে নির্বাহ করেন তাদের জীবন-জীবিকা। এই হাওরের সাথে তাই তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা মিশে আছে ওতপ্রোতভাবে। ভাবতে সত্যিই অবাকই লাগে বাংলাদেশের বৃহত্তম মিঠাপানির এই জলাভূমি পুরো এশিয়ার মধ্যেই অন্যতম জলজ নিদর্শন। ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে এই হাওরের পশ্চিমে আছে ভাটেরা পাহাড় ও পূর্বে আছে পাথারিয়া মাধব পাহাড়। সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার ৫টি উপজেলায় বিস্তৃত এই হাকালুকি ছোট বড় প্রায় ২৩৮টিরও বেশি বিল ও ছোট বড় ১০টি নদী নিয়ে গঠিত। বর্ষাকালে যার আয়তন প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর এলাকায় বিস্তৃত হয়। এই হাওরে বাংলাদেশের মোট জলজ উদ্ভিদের অর্ধেকেরও বেশি এবং দেশের গুরুত্বপূর্ণ ও সংকটাপন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী  প্রজাতি পাওয়া যায়। বলা বাহুল্য হাকালুকি হাওর পরিবেশবান্ধব পর্যটন উন্নয়নের জন্য একটি অমিত সম্ভাবনাময় ত্রে। এ হাওর বছরের বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে। শীত মৌসুমে হাওরের দিগন্ত বিস্তৃত প্রাকৃতিক  দৃশ্য ও বিলের কান্দিগুলি সত্যিই দৃষ্টিনন্দন। বিলের জলের মাঝে ও চারিধারে জেগে থাকা সবুজ ঘাসের গালিচায় মোড়া কিঞ্চিত উঁচুভূমি বিলের জলে প্রতিচ্ছবি ফেলে সৃষ্টি করে অপরূপ দৃশ্য। সূর্যদয় ও সূর্যাস্তের সময় হাওরের জলরাশির মাঝে সূর্যের প্রতিচ্ছবি সত্যই দৃষ্টিনন্দন ও মনোমুগ্ধকর। শীত কালে হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দের্যকে সমৃদ্ধ করে বিভিন্ন ধরণের অতিথি পাখির আগমন ও কলরব। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অতিথি পাখিরা আসে এই হাকালুকি হাওরে খাদ্য ও আবাসস্থলের সন্ধানে এবং বেছে নেয় বিভিন্ন বিল, নদী, খাল, কৃষিভূমি ও বিস্তৃত প্রান্তের তাদের শীতকালীন নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে। হাকালুকি হাওর পরিণত হয় দেশীয় ও অতিথি পাখির মিলনকেন্দ্রে।
হাওরের অনিন্দসুন্দর এই প্রাকৃতিক রুপের বাইরেও আছে একটি মনুষ্যসৃষ্ট বিভৎস ও কুৎসিত দৃশ্যপট। গেল বেশ কয়েক দশক থেকেই এই হাওরকে ঘিরে গড়ে উঠেছে প্রভাবশালী অসৎ চক্র। যাদের লুটপাট সম্পতি রীতিমত মহামারির আকার ধারণ করেছে। ব্যাপক টালবাহানা ও কারচুপির অভিযোগ উঠেছে হাকালুকি হাওরের ৮টি মৎস্য অভয়াশ্রম তৈরি হওয়া নিয়ে। শীত মওসুমে অভয়াশ্রম তৈরির কথা থাকলেও এখনো কাজ শুরুর কোনো প্রক্রিয়া নেই। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২৩৮টি বিল সম্পন্ন হাকালুকি হাওরে ১৮টি মৎস্য অভয়াশ্রম তৈরির অনুমোদন দিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৮টি অভয়াশ্রম তৈরির পরিকল্পনা নেয়া হয়। ৮টি অভয়াশ্রমের মধ্যে গৌরাঙ্গ বিল, মালাম বিল ও কাংলি গোবর কুঁড়ি বিলের অভয়াশ্রম তৈরির দায়িত্ব বর্তায় উপজেলা পরিষদের অন্তর্ভুক্ত মৎস্য বিভাগের উপর। প্রতিটি অভয়শ্রম তৈরির জন্য বরাদ্দ নিশ্চিত হয় ৬৭ লাখ টাকারও বেশি। খবর নিয়ে জানা গেছে, অভয়াশ্রম তৈরির জন্য বিল খননের উদ্যোগ নেয়া হয়ে ছিল। ঢিমেতালে মাটি খননের ফলে খনন প্রক্রিয়া বিঘিœত হয়েছে বারবার। যতটুকু বিল খননের কথা ছিল ততটুকু সম্ভব হয়নি। বড়লেখা উপজেলার অধীন মালাম বিলে ৬০% এবং জুড়ী উপজেলার অধীন গৌরাঙ্গ বিলে ৩৫% কাজ হয়েছে বলে একটি সূত্র দাবি করছে। কুলাউড়া উপজেলার অধীন কাংলী গোবরকুড়ি বিলে অভয়াশ্রম নির্মাণের কথা থাকলেও এখানে কোনো কাজ হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। অপরদিকে হাকালুকি হাওরের তেকুনিয়া কুড়িরমোরা কেশবডহর বিল, মাইয়াজুড়ী, নিমু বিল, রনচি বিল ও মাইছলার ডাক বিলে অভয়াশ্রম তৈরির জন্য সাবেক দায়িত্বে থাকা সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্স স্টাডি (সিএনআরএস) নামে সংস্থার উপর। উল্লেখিত পাঁচটি বিলে এরই বাস্তবতা বিরাজ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া হাকালুকির বিভিন্ন বিলে আসা অতিথি পাখিদের বিষটোপ দিয়ে নির্বিচারে চলছে পাখি শিকারও। এসব দেখার যেন কোথাও কেউ নেই! যাদের দেখার কথা সেই প্রশাসনও নির্বিকার। দেশের যে কয়টি স্থানে অতিথি পাখির সমাগম ঘটে তার মধ্যে হাকালুকি হাওর অন্যতম। অতিথি পাখির সর্ববৃহৎ এই সমাগমস্থলে প্রতি বছর পুরো শীত মৌসুম হাওরে বিচরণ করে পাখিরা আবার গরমের শুরুতেই তারা ফিরে যায় স্ব-স্ব আবাসস্থলে। এ বছর শীত মৌসুমে খাদ্যের সন্ধানে হাকালুকি হাওরের পোয়ালা, চিনাউরা, পলোভাঙ্গা, ধলিয়া, চাতলা, পিংলাসহ বিভিন্ন বিলে আসা এসব অতিথি পাখির অবাধ বিচরণ ল্য করা গেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটে আসে নানা প্রজাতির রঙ বেরঙের লাখ লাখ অতিথি পাখি। পাখিগুলোর অবাধ বিচরণে অন্যরকম সৌন্দর্য ফুঠে ওঠে হাকালুকি হাওরের বিলগুলোতে। কিন্তু এক শ্রেণীর  অসাধু পাখি শিকারি ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছিটানো বিষটোপ আর পাতানো ফাঁদে ধরা পড়ছে হাজার হাজার অতিথি পাখি। ফলে প্রতি বছরই অতিথি পাখির সমাগম হ্রাস পাচ্ছে।

বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে নানা প্রজাতির দেশি-বিদেশি পাখি। হাওরপারের কুলাউড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা তাহসিনা বেগম কুলাউড়া যোগদান করার দেড় মাস মাস হয়েছে। তাঁর আগে ইউএনওর সময় হাকালুকি হাওরের গৌরবিলে ২০১৪ সনের ৮ ডিসেম্বর রোববার বিষটোপ দিয়ে পাখি হত্যা ঘটনায় দুই পাখি শিকারিকে আটক করা হয়। ভ্রাম্যমান আদালত তাদেরকে জরিমানা ও কারাদ-ও প্রদান করেছিলেন। হাকালুকি হাওরের অতিথি পাখিগুলো পাখি শিকারি চক্র যাতে না মারতে পারে সে বিষয়ে প্রশাসন সজাগ রয়েছে বলে জানান কুলাউড়ার প্রথম নারী ইউএনও তাহসিনা বেগম। পরিবেশ অধিদপ্তর কুলাউড়া অফিসের সাবেক (এনআরএমও) বশির আহমেদ মুঠোফোনে জানান, ছোট বড় ২৩৮ বিলের সমন্বয়ে গঠিত এশিয়ার বৃহত্তম এই হাকালুকি হাওরকে সরকার ১৯৯৯ সালে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর ২০০৩ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের অধীনে উপকূলীয় ও জলাভূমি জীববৈচিত্র ব্যবস্থাপনা প্রকল্প (সিডবিউবিএমপি) আওতায় ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে হাওর উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়। ২০১০-১১ অর্থ বছরে সমাজভিত্তিক জলবায়ু পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র সংরণ প্রকল্পের আওতায় আরও ৬ কোটি টাকার প্রজেক্ট পেয়েছেন। যদিও তাঁকে কোটি টাকার প্রজেক্ট হাকালুকি হাওরে আসা সত্ত্বেও হাওরের উন্নতি না হবার কারণ জানতে চাইলে তিনি টাকাগুলো বিভিন্ন আকারে খরচ করতে হয় বলে উড়িয়ে দেন। ২০০৪ সাল থেকে এই প্রকল্পের অধীনে হাকালুকি হাওর উন্নয়ন কাজ শুরু হয়। পুরোদমে শুরু হওয়ার পরও বিগত ৬ বছরে এই প্রকল্পের উন্নয়ন কাজ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও হাওর নিয়ে স্থানীয় জনমনে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টে হয়েছে। বর্তমানে তাদের প্রজেক্ট শেষ হওয়ায় পরিবেশ অধিদপ্তরের কুলাউড়া অফিসের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- অবাধে অতিথি পাখি শিকার বেড়েছে, গণহারে জলজ উদ্ভিদ নির্মূল বেড়েছে, সরকার দলীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় বিল সেচে মাছ ধরাও বেড়েছে। তাছাড়া মাছের অভয়াশ্রম, পাখির অভয়াশ্রম নির্মাণসহ হাওরের পরিবেশের উন্নতি কোনো ভালো ফলাফল নেই।
হাওর পাড়ের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এশিয়ার তথা বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ হাওর হাকালুকির পরিবেশ ও জীববৈচিত্র হুমকির মুখে। ফলে অরতি হয়ে পড়েছে এশিয়ার তথা দেশের বৃহৎ হাওর ও একমাত্র মিঠা পানির এই মৎস্য ভান্ডারটি। হঠাৎ করে এই প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেলে হাওরের অবস্থা আগের অবস্থানে ফিরে যাবে। অবাধে পাখি শিকার, মাছ শিকার, বিনষ্ট হবে পরিবেশ। ফলে এই প্রকল্পের ধারাবাহিকতা রাখতে হবে। হাওরের জীববৈচিত্র রায় যে সাফল্য অর্জিত হয়েছে, প্রকল্প অব্যাহত থাকলে তা আরও উপকৃত হবে। তবে হাওরের প্রকল্পের নামে কিছু এনজিও সংস্থা কাজ করছে শুধুই লোক দেখানো তারা তাদের স্বার্থ হাসিল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিভাগের অধ্যাপক ড.এম আতিকুর রহমানের তত্বাবধানে হাকালুকি  হাওরের উদ্ভিদ বৈচিত্র্য নিয়ে এম.ফিল ডিগ্রি সম্পন্নকারী গবেষক ও জুড়ী তৈয়বুন্নেছা খানম ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ ফরহাদ আহমদ বলেন, বিশ্বব্যাপী জলাশয় যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষনের জন্য সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য সংস্থা ‘রামসার কনভেনশন’এ সংস্থা বিভিন্ন সময়ে বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ন কয়েকটি জলাশয় রামসার সাইট হিসাবে ঘোষনা করে। জাতীয় ভাবে এটাকে যদি রামসার সাইট হিসাবে ঘোষনা করার জন্য উপরোক্ত সংস্থার সহায়তা নেয়া হয় এবং কোনক্রমে তাহলেই দক্ষিন এশিয়ার বৃহত্তম এ জৈববৈচিত্র্যপূর্ণ জলাশয়টি যথাযথভাবে সংরক্ষন করা যাবে।
এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার ২ কুলাউড়া আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল মতিন জানান, আমরা বিভিন্ন সময় হাওর উন্নয়নের বিষয় নিয়ে কথা বলে থাকি। যদিও প্রকল্পের সকল উদ্দেশ্য সফল হয়নি। তারপরও হাওর পাড়ের জনগণের মাঝে হাওর নিয়ে একটা ভালো ধারণা জন্মেছে। এটাকে কাজে লাগিয়ে আগামী দিনে স্থানীয় প্রশাসন  ও জনগণকে নিয়ে হাওর রায় কাজ করতে হবে। যেহেতু এটা প্রজেক্ট তাই একটা সময় শেষতো হবেই।  প্রসঙ্গত, বিল সেচ করে প্রতি বছর মাছ ধরার প্রক্রিয়ায় গত ২০ বছরের মধ্যে হাকালুকি হাওর থেকে ২৬টি প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় হাকালুকি হাওরে অন্তত ২৫টি মৎস্য অভয়াশ্রম তৈরির দাবি উঠেছিল বিভিন্ন মহল থেকে। হাওরপারের স্থানীয় বাসিন্দাদের জোর দাবি এশিয়ার বৃহৎ তথা সিলেট বিভাগে অবস্থিত হাকালুকি হাওরটি সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের বরদ্ধের অভাবে বিলীন হয়ে না পড়ে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ গ্রহন করেন। সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক দমবন্ধকর পরিবেশ বিরাজ করছে এই হাওরকে ঘিরে। যার সামধান কবে হবে বা আদৌ হবে কীনা তা জানেন না কেউই। দিন যায়, যায় মাস আর বছরের পর বছর কিন্তু পরিস্থিতির উন্নয়ণে মাথা ঘামাতে রাজী হন না কোন প্রশাসক কিংবা জনপ্রতিনিধি আর এই বাতাসে কান পাতলে যে কেউ শুনতে পাবেন প্রমত্তা হাকালুকির প্রবল হাহাকার।