সিলেট ২৭শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ই ফাল্গুন, ১৪২৭ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৮:৫৬ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ৩০, ২০১৬
সিলেটসহ দেশের নামিদামি ৫১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একাধিক শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ট্রাস্ট্রি ও মালিকের বিরুদ্ধে জঙ্গি সম্পৃক্ততার পর্যাপ্ত প্রমাণ মিলেছে। এছাড়াও আরো অন্তত ১০৩টি প্রতিষ্ঠান এ ইস্যুতে জোরালো সন্দেহের তালিকায় রয়েছে। তবে এসব স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জঙ্গি কানেকশন গড়ে তোলা হয়েছে, নাকি ব্যক্তিগত উদ্যোগেই সংশ্লিষ্টরা এ সম্পর্ক তৈরি করেছে গোয়েন্দারা এখনো তা নিশ্চিত করতে পারেনি। তাই এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কঠোর নজরদারিতে রেখে তাদের জঙ্গি কানেকশনের মূল ‘লিঙ্ক’ খুঁজে বের করতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে সরকার তাগিদ দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, কোনো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মাদ্রাসার বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জঙ্গি কানেকশন গড়ে তোলা হলে ওইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার জন্য সুপারিশ করা হবে। আর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে জঙ্গি পথে পা বাড়ালে তাকে দ্রুত বহিষ্কারের জন্য গোয়েন্দারা সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানাবে। একই সঙ্গে জঙ্গি সম্পৃক্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, যে ৫১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জঙ্গি কানেকশনের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে এর মধ্যে ১৭টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, ৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ১৩টি ইংলিশ মিডিয়াম কলেজ, ৬টি সরকারি কলেজ, ৯টি বেসরকারি কলেজ ও ৩টি কোচিং সেন্টার।
আর সন্দেহের তালিকায় থাকা ১০৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩৮টি জামায়াত ঘরনার। এর মধ্যে কলেজের সংখ্যাই বেশি। এছাড়াও শিবির পরিচালিত বেশ কয়েকটি খ্যাতনামা কোচিং সেন্টারও এ তালিকায় রয়েছে।
তবে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো- জঙ্গি কানেকশনের সন্দেহে থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি স্কুলের নাম রয়েছে। যা শুধু প্রশাসনই নয়, অভিভাবকদেরও আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে।
মতিঝিল জোনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, খোদ শিক্ষকরাই স্কুলের টিনএজার শিক্ষার্থীদের জঙ্গি মতবাদে মোটিভেট করছেন- এমন খবর তাদের কেউই প্রথমে বিশ্বাস করেনি। তবে পরে খোঁজখবর নিয়ে যে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে তাতে সবার চোখই কপালে উঠেছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষস্থানীয় একজন কর্মকর্তা জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জঙ্গি কানেকশনের এ ইস্যুটি এখন মারাত্মক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে কোনো স্কুল-কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হলে সেখানে অধ্যয়নরত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে। অথচ এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে দেশ ও জাতি হুমকির মুখে পড়বে।
ওই কর্মকর্তার দাবি, এ ধরনের উভয় সংকট পরিস্থিতিতে তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জঙ্গি কানেকশনের বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করে শতভাগ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তা গোপন রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে অনুরোধ জানিয়েছেন। কারণ কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জঙ্গি সম্পৃক্ততার খবর প্রকাশ হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবকদের মাঝেও ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এমনকি এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদেরও সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতে চাকরি করাও কঠিন হবে বলে মনে করেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওই শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জঙ্গি তৎপরতা তদন্তে বুধবার তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন-ইউজিসি। এই কমিটি পর্যায়ক্রমে সব বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে যাবে। ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. আখতার হোসেনকে এই কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। আর এই কমিটির সদস্য সচিব হলেন জেসমিন পারভীন (উপ-পরিচালক), সদস্য শাহীন সিরাজ (উপ-সচিব)।
অন্যদিকে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) নিজ নিজ এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর এ জন্য বেশকিছু কৌশলও তৈরি করা হচ্ছে। যাতে ডিসিরা প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে তদারকি করতে পারেন।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানায়, জঙ্গি কানেকশন থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরের। এছাড়া জামায়াত অধ্যুষিত দরিদ্র অঞ্চলগুলোতে এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি। সেখানে ধর্মীয় মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করার নামে প্রথমে শ্রেণিকক্ষে নানা আলোচনা শুরু হলেও পরবর্তীতে তা মগজধোলাই পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে।
পরবর্তীতে বাছাইকৃত শিক্ষার্থীদের কথিত জিহাদের নামে জঙ্গি তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তাই এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষাক্রমের পাশাপাশি অন্যান্য কার্যক্রমও নজরে রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও সন্দেহভাজন শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের গতিবিধি নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখা হবে।
এদিকে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের বিরুদ্ধে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অকাট্য প্রমাণ মিলেছে সেগুলোর নাম এখনো প্রকাশ করা না হলেও এরই মধ্যে ওই তালিকায় থাকা বেশ কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম-সুখ্যাতিতে ব্যাপক ধস নেমেছে।
বিশেষ করে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এখন অনেকের কাছেই এক আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি এ তালিকায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (এআইইউবি) নামও উঠে এসেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গুলশান কিলিং, কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার হামলা, পুরোহিত হত্যা, বস্নগার হত্যা ও বিভিন্ন ব্যক্তিকে হত্যার হুমকির সঙ্গে যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে তাদের একটি বড় অংশ নর্থ সাউথের শিক্ষার্থী। একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্তত দুজন শিক্ষকের বিরুদ্ধেও জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। অতিসম্প্রতি কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানকালে পুলিশের গুলিতে যে ৯ জন নিহত হয়েছে এদের তিনজন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলে জানা গেছে। এছাড়াও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে।
এদিকে গুলশান হামলাকারীদের অন্যতম হোতা রোহান ইমতিয়াজসহ অন্তত দুই জঙ্গি রাজধানীর স্কলাসটিকা স্কুলের শিক্ষার্থী হওয়ায় গোয়েন্দারা তাদের নজরদারির তালিকার প্রথমভাগে খ্যাতনামা এ বিদ্যাপীঠের নাম রেখেছে।
গুলশানের জঙ্গি হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে নিখোঁজ যে ১০ যুবকের তালিকা আসে তার একজন এটিএম তাজউদ্দিন কাউসার ঢাকার আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী হওয়ায় এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, এর আগেও এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে।
এছাড়াও জঙ্গি অর্থায়নে বেশ কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম এসেছে। গোয়েন্দারা এসব প্রতিষ্ঠানের ট্রাস্টি ও মালিকদের গতিবিধি নজরদারির পাশাপাশি শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং পাঠ্যকার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছে।
এদিকে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল, সানিডেলসহ ইংলিশ মিডিয়ামের নামিদামি বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে সন্দেহের তীর রয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। সেখানকার শ্রেণিকক্ষে সাধারণ পড়াশোনার বাইরে আরো কোনোকিছু পড়ানো হয় কিনা কিংবা ক্যাম্পাসের অন্য কোথাও কোনো বয়ান ও মজলিস বসে কিনা তাও খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দারা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, বগুড়া, গাইবান্ধা, রংপুর, দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও কক্সবাজারসহ ১৪টি জেলার ১০৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সন্দেহের তালিকায় রেখে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে বিশেষ কোনো ছাত্র-শিক্ষকের নামে রেমিট্যান্স আসে কিনা তা খুঁজে দেখা হচ্ছে।
অন্যদিকে বেশ কয়েকটি গুপ্তহত্যার সঙ্গে জড়িত অন্তত তিনজন মালয়েশিয়ার মোনাস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে বাংলাদেশি ছাত্ররা সেখান থেকেই উগ্রপন্থিদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। তাই ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশি কতজন ছাত্র লেখাপড়া করছে, তাদের পরিবারের সঙ্গে কতটা যোগাযোগ রয়েছে এর খোঁজ নেয়া হচ্ছে।
গোয়েন্দারা জানান, গুলশানে নিহত পাঁচ জঙ্গির একজন নিবরাস সেখানেই লেখাপড়া করত। এ ছাড়া এই পাঁচজনই একাধিকবার মালয়েশিয়ায় গিয়েছে। যে ছয় মাস এরা নিখোঁজ ছিল, সেই সময়ে একাধিকবার তারা মালয়েশিয়া সফর করেছে বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, অকার্যকর মনিটরিং সেল, দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো, যথাযথ গোয়েন্দা নজরদারির অভাবসহ নানা কারণে জঙ্গি সংগঠনগুলো দিন দিন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সক্রিয় হচ্ছে। শহুরে শিক্ষিত পরিবার থেকে আসা আর স্বনামধন্য ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল এবং বাংলাদেশের নামকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া টগবগে তরুণরা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে সবার অজান্তে জঙ্গি হয়ে উঠছে। এছাড়াও অভাবগ্রস্ত পরিবার ও তাদের সন্তানদের আর্থিক সহায়ত দিয়ে জঙ্গি দলে ভিড়ানো হচ্ছে।
এ ব্যাপারে হিযবুত তাহরীর সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে বলে দাবি করেন গোয়েন্দারা।
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : মোঃ আফছর আহমদ
সম্পাদক ও প্রকাশক : মস্তাক আহমদ পলাশ
নির্বাহী সম্পাদক : নাজমুল কবীর পাভেল, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : উজ্জ্বল চৌধুরী।
মস্তাক আহমদ পলাশ কর্তৃক নিউ বর্ণমালা অফসেট প্রেস, রাজা ম্যানশন, জিন্দাবাজার, সিলেট থেকে মুদ্রিত ও ব্লু-ওয়াটার শপিং সিটি, ৯ম তলা (লিফটের-৮), জিন্দাবাজার, সিলেট থেকে প্রকাশিত।
ইমেইল : sylheterdinkalnews@gmail.com,
ফেইসবুক পেইজ : The Daily Sylheter Dinkal ০১৭১২৫৪০৪২০, ০১৭১১৯৮৪০৬৫, ০১৭১৮৫৩৮০৪৫ , ০১৭১১-৩২৬০৯১, শ্রীহট্ট মিডিয়া লিমিটেডের একটি প্রতিষ্ঠান।
Design and developed by best-bd